সদ্য শেষ করা বইটা বন্ধ করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাদিয়া। রাসুল (সাঃ) এর কন্যা ফাতিমা কে নিয়ে লেখা বই। ইদানীং কেন যেন বইয়ের পোকা রাদিয়াকে উপন্যাস আর টানে না। বরং আদর্শ মানুষদের জীবনী পড়তে যেন বেশি ভালো লাগে।
“এতো ভালো মানুষ হয়!” মনে মনে ভাবলো সে। “এতো কষ্টের ভিতর কি করে ধৈর্য রাখতেন? সন্তানদেরই বা কি করে লালন পালন করতেন?”
ভাবতে না ভাবতেই তার নিজের সন্তান মারিয়া এসে হাজির হল। অনেক কষ্টে সোফার উপর উঠে মায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো, “আম্মু, আজকে রাতে গল্প শুনাবে না?”
তাইতো! অনেক রাত হয়ে গেছে বই পড়তে পড়তে, এদিকে গল্পের পোকা তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে অস্থির হয়ে আছে। গল্প না শুনে সে ঘুমাবে না। তাও ভালো পরদিন শুক্রবার।
– “হ্যা আম্মু শুনাবো।”
– “কোন প্রিন্সেস এর গল্প?”
হাতের বইটার দিকে তাকালো একবার রাদিয়া। তারপর একপাশে রাখতে রাখতে বললো, “আজকে শোনাবো অন্য রকম এক প্রিন্সেস এর গল্প। প্রিন্সেস ফাতিমার গল্প।”
রূপকথা পাগল মেয়ে প্রিন্সেস ছাড়া কোন কাহিনীই শুনবেই না। অদ্ভুত স্বভাব। তাই প্রিন্সেস শব্দটার আশ্রয় নিতে হল রাদিয়াকে। তবে গল্প নয়, সত্যিকার কাহিনী বলতে চায় সে- ফাতিমা (রাঃ) এর আসল জীবনী।
মেয়েকে মুখামুখি বসিয়ে বলা শুরু করলো রাদিয়া। ফাতিমা (রাঃ) এর জীবনের অনেক গুলো ঘটনা এক এক করে বর্ননা করে গেল। কি করে বিলাস বিহীন জীবন যাপন করতেন, সেসব ও বললো। বলতে বলতে এক পর্যায়ে এসে সে থেমে গেলো, এখন মৃত্যুর ঘটনা ছাড়া তো আর কিছু তার জানা নাই।
– “তো, আম্মু। কেমন লাগলো কাহিনী?”
– “কাহিনী শেষ?”
– “হ্যাঁ।”
– “কিন্তু… কিন্তু… ওর প্যালেস কই? হ্যাপি এন্ডিং কই?”
– “এই প্রিন্সেস এর প্যালেস নাই, মা। তবে সে হ্যাপি ছিলো।”
– “উহু। এত কষ্টের মধ্যে কেউ হ্যাপি হয় নাকি? নিশ্চয়ই তুমি পুরাটা জানো না।”
– “পুরাটাই বলেছি।”
– “পঁচা গল্প!”
– “কি বললে মারিয়া???”
এমন কথা শুনে প্রচন্ড রাগ উঠে গেলো রাদিয়ার। কত বড় সাহস, ফাতিমা (রাঃ) এর জীবনী সম্পর্কে এমন কথা বলে! “আরেকবার বলো দেখি?”
মায়ের রাগ দেখে মারিয়া এক দৌড়ে নিজের রুমে পালালো। খুব অভিমান হচ্ছে মায়ের উপর। সিন্ডারেলার গল্প বলার সময় তো কত বুঝিয়েছিলো আম্মু, কষ্ট করলে পুরষ্কার পাওয়া যায়। তাহলে ফাতিমা কেন পেলো না? “ধুর, আম্মু পুরাটা জানেই না।”
এদিকে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলো রাদিয়া। আসলে তো মারিয়ার দোষ না, ওকে তো কখনো ওভাবে শিখানো হয়নি। প্রতিদিন বানোয়াট সব গল্প শুনে এখন সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য মনে করছে। আর এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী রাদিয়া নিজেই। কল্পনা শক্তির বিকাশে সহায়তা করতে গিয়ে মেয়েকে বাস্তব জ্ঞানহীন, উচ্চাভিলাষী বানিয়ে ফেলেছে। আর নৈতিক শিক্ষা তো বাদই!
মেয়ের রুমের সামনে গিয়ে উঁকি দিলো রাদিয়া। মারিয়ার হাতে ‘আলাদীন’। হঠাত প্রচন্ড ভয় লাগলো তার। “ও কি কি শিখেছে এর থেকে? ও কি আলাদীন এর মত চোর হবে, নাকি প্রিন্সেস জেসমিনের মত চোর বিয়ে করবে?” মাথাটা মনে হচ্ছে চক্কর দিয়ে উঠলো রাদিয়ার। নিজের রুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
অনেক দিন ধরে তাহাজ্জুদ এর নামায পড়ার ইচ্ছা ছিলো রাদিয়ার, কিন্তু উঠতে পারেনি। আজ পেরেছে। আল্লাহর কাছে খুব করে মাফ চেয়েছে নিজের ভুলের জন্য, আর সাহায্য চেয়েছে।
নামাজ শেষে মনটা অনেক হালকা লাগছে। মনে নতুন একটা আশারও সঞ্চয় হয়েছে।
মারিয়ার রুমে গিয়ে তাকে আস্তে করে ডাকলো রাদিয়া। মেয়ের ঘুম বেশ পাতলা। ডাকতেই চোখ পিটপিট করে তাকালো।
– “এহহ…সকাল হয়ে গেছে?”
– “না, মা।”
– “তাহলে?”
– “কালকের গল্পটার শেষ মনে পড়েছে।”
শুনেই তড়াক করে উঠে বসলো মারিয়া, চোখে বিস্ময় নিয়ে। রাদিয়া বললো, “তুমি ঠিকই বলেছিলে, ফাতিমার একটা প্যালেস হয়েছে। খুব সুন্দর প্যালেস। সেখানে সে সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাস করে।”
এবার মারিয়ার মুখে বিজয়ীর হাসি। রাদিয়া আরো বললো, “তবে কিনা প্যালেসটা এই পৃথিবীতে পায়নি। পেয়েছে জান্নাতে। আল্লাহ্ তায়ালা তার সব কষ্টের পুরষ্কার হিসেবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে দিয়েছেন। সেখানে সে যা চাইবে, তাই পাবে।”
মারিয়া চোখ বড় বড় করে সব শুনছে।
– “সত্যি যা চাইবে তাই পাবে?”
– “হ্যা। অবশ্যই। তুমি গেলে তুমিও পাবে।”
– “কি করে যেতে পারবো আমি? আমি তো কষ্ট করি না কোন। না খেয়ে থাকি না।”
– “না খেয়ে থাকতে হবে না। খাওয়ার পর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাবে। যারা খেতে পায়না তাদের খাবার খেতে দিবে।”
– “আর?”
এরপর এক এক করে মেয়েকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল রাদিয়া। ওদিকে মারিয়ার ও আগ্রহের যেন শেষ নাই। মেয়ে যে তার এত ভালো রাদিয়া নিজেও মনে হয় জানতো না!
* * ** * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
বারান্দায় বসে ভোরের আলোয় কুরআন তিলাওয়াত করছে রাদিয়া। পাশে মারিয়া। দুজনে আজ এক সাথে ফজর নামাজ পড়েছে।
– “আচ্ছা আম্মু, তুমি কি ম্যাজিক করতে জানো?”
এই রে, আবার রূপকথা আসলো কি করে! রাদিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। মারিয়া নিজেই ব্যাখ্যা করলো, “তুমি যখন পড়ছিলে, তখন খুব ভালো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন ম্যাজিক!”
মেয়ের কথায় হেসে কুটিকুটি রাদিয়া। একটু রহস্য করে বললো, “তার কারণ, এর মধ্যে ম্যাজিক আছে।” হাতের কুরআন টাকে উঁচু করে ধরলো।
– “আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এটা ভালো মানুষদের জন্য উপহার! এর মধ্যে অনেক ভালো ভালো সত্যিকার কাহিনী আছে, আর-“
– “প্রিন্সেস ফাতিমার কাহিনীর মত?”
– “হুম। ওরকমও আছে।”
– “আমাকে শুনাবে?”
– “অবশ্যই।”
– “প্রতি রাতে?”
– “আচ্ছা!”
– “প্রমিস?”
– “ইন শা আল্লাহ্, মা। এখন থেকে প্রমিস না বলে আমরা ইন শা আল্লাহ্ বলবো, ঠিক আছে আম্মু? এবার যেয়ে আরেকটু ঘুমিয়ে নাও।”
মারিয়া উঠে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল। রাদিয়া তাকে কি মনে করে আবার ডাক দিল।
– “মারিয়া!”
– “কি, আম্মু?”
– “এখন থেকে প্রিন্সেস ফাতিমা না বলে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলবো আমরা, আচ্ছা?”
– “ইন শা আল্লাহ্, আম্মু।”
মারিয়ার মুখে সুন্দর একটা হাসি খেলে গেল। অবাক হল রাদিয়া। বাচ্চারা কি সবাই এত সরল হয়? এত সহজে বুঝে যায় সব? নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এর দেয়া ফিতরাতের কারণে! অন্য বাচ্চাদের মায়েরা কি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে?
মারিয়া যাওয়ার পর নিজেও ঘরের ভিতর ঢুকলো রাদিয়া। টেবিলের উপর একটা ডায়েরি ছিলো, সেটা খুঁজে বের করলো। চেয়ারে বসে হাতে কলম নিলো। মাথার মধ্যে খেলে যাচ্ছে রাসূল (সাঃ) এর জীবনীতে পড়া সব অসাধারণ ঘটনা, কুরআনের সব অবাক করা কাহিনী। ঠিক যেন রূপকথার মতই, কিন্তু সবই সত্য। একদম সত্য!
ছোটবেলা থেকেই লেখার হাত ভালো রাদিয়ার। এবার অবশ্য গল্প না, সত্য কাহিনী লেখার পালা। মারিয়ার মত কচি মন গুলোকে মিথ্যার জগত থেকে বাঁচাতে হবে যে!
* * * * * ** * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
পর্দার ফাঁক দিয়ে উদীয়মান সূর্য্যের আলো এসে রাদিয়ার ডায়েরির উপর ছেয়ে গেল, যেখানে সে সদ্যই লিখেছে তার নতুন বই এর নাম-
‘সত্য রূপকথা’।
সত্য রূপকথা
বিনতে আব্দুল্লাহ
(৩০ নভেম্বর ২০১৭)