সকাল ১১টা বেজে ২মিনিট।
হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লো রাদিয়া। তার মেয়ের স্কুল ছুটি হতে এখনো এক ঘন্টা বাকি। আজ তার আরবি ক্লাসের প্রথম দিন ছিলো বলে আগে ভাগেই ক্লাস শেষ হলো, নাহলে মেয়ের স্কুল ছুটির কিছুক্ষণ আগেই তার ক্লাস শেষ হতো। ইচ্ছে করেই সে এই সময় বেছে নিয়েছে- মেয়েকে স্কুলে দিয়ে নিজের ক্লাসটাও সেরে নেয়া যাবে বলে। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, সব কিছু এভাবে মিলিয়ে দেয়ার জন্য।
এক ঘন্টায় বাসায় গিয়ে যেহেতু লাভ নেই, তাই আরবি কোর্সের ওয়েটিং রুমে বসেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল রাদিয়া। কাছেই তার মেয়ের স্কুল, ছুটির ঘন্টা বাজলেও শুনতে পাবে এমন দূরত্ব। হঠাৎ রাদিয়ার দিকে একটি মেয়ে এগিয়ে আসলো, ক্র্যাচে ভর করে। তারপর তার পাশের চেয়ারে ধপাস করে বসলো। বসার সময় ক্র্যাচটা হাত থেকে পড়ে গেল মাটিতে। রাদিয়া জলদি করে সেটা তুলে দিল তার হাতে। তাতে মেয়েটি ভুবন ভোলানো হাসি হেসে বললো, “জাযাকিল্লাহ খাইর।”
রাদিয়াও প্রত্যুত্তর দিলো হাসি মুখে, কিন্তু মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো। সকালে ক্লাসে ঢুকতেই অসম্ভব সুন্দর এই মেয়েটির দিকে চোখ পড়েছিলো তার। মনে মনে ভেবেছিলো, কতই না ভাগ্যবতী সে। আর এখন জুতার ফাক দিয়ে তার নকল পা জোড়া দেখে খারাপই লাগছে খুব। কি দুর্ভাগাই না মেয়েটি! কেমন করে এমন পরিনাম হলো কে জানে!
“আমার নাম রুকাইয়া। রুকাইয়া গোমেজ।”
মেয়েটির কথাতে হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়লো রাদিয়ার। মনে হয় মেয়েটির হাতেও বেশ সময় আছে, তাই তার সাথে আলাপ করতে ইচ্ছুক। রাদিয়া খানিকটা ঘুরে বসে নিজের নাম বললো। ক্লাসমেট বলে কথা, বন্ধুত্ব যত জলদি হবে ততই ভালো। তাছাড়া মেয়েটিকে নিয়ে রাদিয়ার মনে ইতিমধ্যেই অনেক কৌতুহল জন্মেছে। একটা প্রশ্ন না করে থাকতে পারলো না-
– “আপনি কি… মানে… রিভার্ট মুসলিম?”
– ”জী। গত বছর শাহাদা নিয়েছিলাম। আগে খ্রিষ্টান ছিলাম। আমার মা বাবা এখনো তাই আছেন।”
– ”তারা কি মেনে নিয়েছেন ব্যাপারটা?”
– ”হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ। মেনে নিয়েছেন এবং আমাকে সব রকম সহযোগিতাই করেন। এই যেমন আমার এই আরবি ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছেন আমার বাবা, আমার অনুরোধে অবশ্য। আর আমাকে আনা নেয়া করেন আমার মা।”
– ”তাই বুঝি! আর ভাই বোন?”
– ”আমি একমাত্র সন্তান আমার মা বাবার।”
– ”হাজব্যান্ড?”
– ”হতে হতেও হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ। (হাসি) আমার একসিডেন্ট এর পর সে পিছটান দিয়েছে। তার দোষ দিবো না, পা হীন মেয়েকে কে স্ত্রী করতে চাইবে?”
– ”স্যরি! এভাবে বলা উচিত হয়নি আমার।”
– ”না না! ঠিক আছে। আলহামদুলিল্লাহ।”
রাদিয়া অবাক হলো। এই অল্প কদিনে নিজের ঈমানকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে রুকাইয়া! ঠোঁটে সারাক্ষণ হাসি আর কথায় কথায় আলহামদুলিল্লাহ! ত্রিশ বছরে সে যা আয়ত্ত করতে পারেনি, রুকাইয়া তা এক বছরে পেরেছে। রাদিয়া প্রশ্ন করলো আবারও-
– “আমার না খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছে, আপনি মুসলিম হলেন কি করে। বলা যাবে কি?”
– ”অবশ্যই! তবে সেটা কিন্তু অনেক লম্বা কাহিনী।”
– ”আমার আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া কোন কাজ নেই।”
– ”ঠিক আছে তাহলে। শুরু থেকেই বলি…..”
* * * *
“ছোটবেলা থেকেই আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলাম এবং দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করতাম। নিজ ধর্ম নিয়ে আমি গর্বিত ছিলাম। তবে, অন্য ধর্মের মানুষের প্রতিও আমার শ্রদ্ধা ছিলো। আমি বিশ্বাস করতাম, সব ধর্মের উপর মানব ধর্ম।
স্বভাবতই আমি মুসলিম, হিন্দু – সহ সব ধর্মের বন্ধুদের সাথে চলাফেরা করতাম। সব ধর্মের আচার অনুষ্ঠান নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল। তবে মুসলিমদের একত্রে নামাজ পড়া দেখতে আমার কেন জানি খুব ভালো লাগতো। মন খারাপ হলে বাসার কাছের মসজিদের কাছে চলে যেতাম। দূর থেকে মুসলিমদের সারি বেঁধে নামাজ পড়তে দেখলে মনটা শান্তিতে ভোরে যেত।
পড়ালেখায় ভালোই ছিলাম সবসময়। কোন পরীক্ষায় আল্লাহ সেকেন্ড করেননি। এভাবে সাফল্যের সাথে স্কুল কলেজের পাঠ চুকিয়ে এক নামকরা ভার্সিটিতে ভর্তি হই। সেখানে এক খ্রিস্টান বন্ধু জুটে, নাম এরিক। সে অল্প সময়েই খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায় আমার। এক সময় সে আমাকে ভালো লাগার কথা জানায়। আমারও তাকে অনেক ভালো লাগতো। আমরা ঠিক করি আমার পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে করবো। আমাদের পরিবারও সম্মতি দিয়ে দিয়েছিল এক কথাতেই।
এক সময় আমি অনার্স মাস্টার্স শেষ করে ফেলি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় এর টিচার হওয়া সময়ের ব্যাপার। বিদেশের একটা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ ও যোগাড় হয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে আমি তখন হাওয়ায় ভাসছিলাম।
গত বছর ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে আমাকে একটি পার্কে দেখা করতে বলে এরিক। আমি অনুমান করেছিলাম কেন ডেকেছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য হয়তো। সেই চিন্তায় আমি সারাটাদিন বিভোর হয়ে ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, সবই ছিল আল্লাহর ইচ্ছা। আনমনা আমি পার্কে যাওয়ার পথেই একসিডেন্ট করি, আর পা দুটি হারাই।
সেদিনের পর এরিক আর কোনদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। প্রতিদিন তার ফোনের আশা করেছি, কিন্তু…. যাই হোক। একইসাথে আমার স্কলারশিপ, টিচার হওয়ার স্বপ্নগুলোও সব শেষ হয়ে গিয়েছিলো। পায়ের সাথে মেরুদন্ডও বাজে ভাবে ঘায়েল হওয়ায় আমি কয়েক মাস বিছানাতেই ছিলাম। সেই সময় আমার সঙ্গী ছিল কেবল- বাবা,মা আর ইন্টারনেট।
হ্যাঁ, তীব্র হতাশা কাটিয়ে উঠতেই সঙ্গী করেছিলাম ইন্টারনেটকে। আলহামদুলিল্লাহ, অজানা অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম তার ফলে। কিন্তু তবুও প্রতি রাতে ব্যথায় কাতরাতে থাকার সময় কোন ভাবেই চোখের পানি আটকাতে পারতাম না। নিজের জীবন নিয়ে কোন আশাই ছিল না আর।
এমনি এক রাতে, কেঁদে অস্থির হয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম একটা, জীবনের মোড় ঘুড়ে গিয়েছিলো ওই এক স্বপ্নে।
স্বপ্নে আমি আপাদমস্তক ঢাকা কালো রং এর পোশাক পরে একটা মরুভূমির মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম। রাতের মরুভূমি, অন্ধকার চারিদিকে। আমি অসহায়ের মতো খালি ছুটছিলাম- একটু সাহায্যের আশায়। হঠাৎ দূরে আলো দেখে কাছে ছুটে কাছে যেতেই দেখি আগুন এর চারপাশে কিছু মানুষ, কারোরই চেহারা দেখা যাচ্ছিলো না।
আমি কাছে গেলাম। সবাই সরে গিয়ে আমাকে জায়গা করে দিলো। আমার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো যে তিনি সবার নেতা। তার চেহারাও ছায়ায় ঢাকা ছিলো। আমি মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম যে তিনি ছিলেন যীশু। কিন্তু একজন উনাকে সম্বোধন করলেন রাসূলুল্লাহ বলে। আমি বুঝে গেলাম, উনি মুহাম্মাদ (সাঃ)! সুবহানাল্লাহ!
মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন- যীশু ছিলেন আমাদেরই মত একজন মানুষ ও আল্লাহর দাস। তিনিও আমাদের মত ঘুমাতেন, আহার করতেন।
ব্যাস, অতটুকুই। এর পর আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি কাঁদতে থাকি। আমি বুঝতে পারি স্বপ্নটা অহেতুক ছিল না। হঠাৎ করে আমার মনে পরে যায় মসজিদের কথা, নামাজের দৃশ্যের কথা। আমি বুঝতে পারি আমার গন্তব্য কোথায়।
পরদিন সকালে আমি আমার বাবা মা কে সব খুলে বলি। তাদের বলি যে আমি মুসলিম হতে চাই। তারা অবাক হন, কিন্তু কেন যেন কোন প্রতিবাদ করলেন না। হয়তো আমি অসুস্থ ছিলাম বলে তারা আমাকে না করতে পারেননি।
তারপর সেদিনই, আমার এক মুসলিম বন্ধুর কাছে শাহাদা নেই আমি। আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন ছিলো সেদিন। আলহামদুলিল্লাহ।
আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করে, আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য কোনটি, আমি বলবো- আমার এক্সিডেন্ট। কারণ এর মাধ্যমেই আল্লাহ আমাকে ইসলামকে চেনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সব হারিয়েই আমি আল্লাহর ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ…..”
* * * *
রুকাইয়া আর রাদিয়া, দুজনের চোখেই পানি। রাদিয়া যেন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। রুকাইয়াই প্রথমে চোখ মুছে বললো- “স্যরি, এভাবে ইমোশানাল হয়ে পড়েছিলাম বলে। ওই যে আমার মা এসেছেন। আজ তাহলে উঠি।”
রাদিয়া চোখ মুছে তাকে উঠতে সাহায্য করলো। তাতে রুকাইয়া আবারও বললো, “জাযাকিল্লাহ”। এরপর মায়ের হাত ধরে হাসি মুখে বিদায় নিলো। এত সুন্দর হাসি রাদিয়া আগে কখনো দেখেনি। এত নূর আগে কারো চেহারায় দেখেনি।
রুকাইয়া চলে যাওয়ার পর রাদিয়া মনে মনে ভাবলো, সারাজীবন খালি আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেছে কষ্ট নিয়ে। কখনো চিন্তাও করেনি প্রতিটি কষ্টের মধ্যে লুকিয়ে আছে আল্লাহর অনুগ্রহ। আমাদের কাছে টানতে আল্লাহর কত প্রয়াস, আমাদের প্রতি তাঁর কত ভালোবাসা! এমন ভালোবাসা উপেক্ষা করা যায় কী?
(গল্পটি কাল্পনিক, তবে এক নওমুসলিমের সত্যিকার জীবনকাহিনীর ছায়া অবলম্বনে লেখা)
…………………………..
ভালোবাসা
বিনতে আব্দুল্লাহ
(১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮)