মা, সেতো মা’ই, তা সে যেমনই হোকনা কেন!
কালকে একটা লেখা পড়ে অনেক পুরানো কথা মনে পড়ে গেল। এক ব্যর্থ মায়ের গল্প!
৭ বছর হতে চলেছে বড় ছেলেটার। প্রায় ৭ বছর আগের কথা, তখন নতুন মা আমি। অনেক কিছুই বুঝিনা। সেইসাথে এটাও বুঝিনা, একটা বাচ্চার খেতে কতক্ষণ লাগে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক বুকে মুখ লাগিয়ে রেখেও যে টানতে থাকতো। না পেরে পিঠে কাধে ব্যাথায় কাতর হয়ে তাকে নামাতাম। এক ঘণ্টা চেস্টার পর ঘুমের ডিউরেশন ১৫ মিনিট ! কিভাবে সম্ভব!! “শিশুর মত ঘুম ” এই কথাটার উপর অবিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে। বাচ্চাটা রাতে জন্মেছে, আর সেদিন থেকেই শুরু আমার, আমাদের রাতজাগা। আমার রাতজাগার অভ্যাস আগে থেকেই, পড়াশোনা সবসময়ই ছিল রাতের কাজ। কিন্তু বিয়ের পর এই অভ্যাস পাল্টাতেই হল। ওর সকালে ইউনিভারসিটিতে ক্লাস, তারপর অফিস। চেষ্টা থাকতো রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার।
কিন্তু আমার বড় রাজপুত্র জন্মের পর থেকে এই রুটিন পালটে গেল। রাতে ১০টায় শুলে সে ঘুমাতো রাত ১ টায়। ছেলের গরম লাগে বেশি, ঘেমে ঘুমাতে পারেনা। বাবা জলদি করে ঘরে এসি লাগিয়ে দেয়, যদিও নিজেরা গরম সহ্য করেই যাচ্ছিল; কিন্তু পুত্র বলে কথা!
কিন্তু তাতে কি, সে যে তাও ঘুমায় না। দরজা, জানালা লাগিয়ে, ঘর অন্ধকার করে, বাবা ঘাড়ে নিয়ে একটার পর একটা সুরা পড়েই যাচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে, কিছুক্ষণ পর মায়ের কাছে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা। মা কিছুক্ষণ বুকের মাঝে শুইয়ে, খাইয়ে যে পাশ ফিরলো চিৎকার দিয়ে কান্না। রাত তখন ২ টা। জলদি ওকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা। বাবার কাচা ঘুম ভাংলো বলে। এরপর পায়ে নিয়ে দোলাতে দোলাতে আরো এক ঘন্টা। অনেক সাবধানে পা থেকে নামিয়ে একটু স্বস্তি।
ফজরের নামাজে ওঠা দায়, আর উঠলে যার নামাজ নেই, তিনিই কেঁদে সবাইকে ওঠান। রাতে না ঘুমানোর ফল, সকালে চোখ মেলা কঠিন হয়ে যেত। সারারাত ধরে কি করি, এই প্রশ্নের কোন জবাব ছিলনা। আমার এক রিলেটিভ প্রায়ই বলতেন, তাদের বাচ্চারা রাতে ১০ টার মধ্যে ঘুমাতো, তিনি আর কি কি করেছেন ;তিনি একজন সফল মা। থাকতেন একই বিল্ডিং এ, আমার ছেলেটা তার কাছে থাকতো প্রায়ই। একদিন নিজেই রাতে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব নিলেন; ঘন্টাখানেক পর ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। হাসিমুখে বললেন, “কি জানি বাপু, আমাদের বাচ্চারা তো এমন ছিলনা। এতক্ষণ শুয়ে থেকেও ঘুমায়না কেন? “
এভাবে কতরাত আর কতদিন কেটেছে হিসাব নেই। দুই বছর হবার পর কিছুটা ঘুমের উন্নতি হয়। ওর যখন আড়াই, তখন আমার ছোট্ট রাজপুত্রর জন্ম। আলহামদুলিল্লাহ্, তার ঘুমের প্রকৃতি এত জটিল ছিলনা। তবু দু’জনাকে একসাথে সামলানো খুব সহজ ছিলনা। তাদের বাবার পড়াশোনা তখনো চলছে। তাকে প্রায়ই আলাদা ঘরে দিতাম যাতে তার ঘুমের ব্যাঘাত না হয়। এভাবে প্রায় পাঁচ বছর। বড়জনকে স্কুলে দেয়ার পর তার ঘুমের রুটিন ঠিক করতে পেরেছিলাম। আর ওর খাওয়া-দাওয়ার কথা নাই বলি, পোস্ট আর শেষ হবেনা।
এখন আমার ছেলেরা রাত নয়টায় ঘুমাতে যায়। সকালে বাবার সাথে খেলতে যায় মাঠে। এরপর স্কুল। সময় লেগেছে এতগুলো বছর এই রুটিনে আনতে। এই কয় বছর না আমি ঠিকভাবে সংসারে সময় দিতে পেরেছি, একজন স্ত্রী হিসেবে, বাড়ির বৌ হিসেবে না কারো কন্যা হিসেবে। আমার সমস্ত পরিচয়ের উপরে শুধুই একটা পরিচয়, কারো মা।
কেউ যখন বলেন, মায়ের অবহেলায় সন্তান সময়মত ঘুমায় না, সেটা কতটা ঠিক? এতকিছুর পরও যখন গায়ে ব্যর্থতার তকমা লাগে, সেটা সরাসরি বুকের মাঝে গিয়ে আঘাত করে।
একজন মাকে জাজ করা এতই সোজা? এটা কেন মানুষ বোঝেনা, যাদের বাচ্চাদের সবকিছু সঠিকভাবে, সময়মত হয়,বিশেষ করে খাওয়া, ঘুম, সুস্থতা, সেটা আল্লাহর নিয়ামত। আর যাদের এসব নিয়ে কষ্ট, সেটা আল্লাহর পরীক্ষা। এই পরীক্ষার ফল শুধু তিনিই দিবেন, যে কারনে মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত। আমরা কোন মাকে জাজ করার আগে নিজের নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি, আল্লাহ সেই পরীক্ষায় আমাকেও ফেলতে পারতেন।
তাই মায়েদের দল, ভয় পাবেননা। আপনার কষ্টের ফল মিলবেই, দুদিন আগে বা পরে। কারো কটু কথায় কান না দিয়ে আপনার দায়িত্ব পালন করে যান। আপনি মা হিসেবে সফল না ব্যর্থ সেটা বিচারের মালিক একমাত্র আল্লাহ।
ব্যর্থ মা
ফাহমিদা হুসনে জাহান