প্রিয় আপু,
আসসালামু আলাইকুম। আশা করি আল্লাহ এর রহমতে ভালো আছ। অনেক দিন ধরে ভাবছি, তোমায় লিখব। তোমার সাথে এমন কিছু কথা শেয়ার করবো, যেসব আমি কোনক্রমেই ভুলতে পারছি না। আমার মনের গভীরের এই ক্ষতগুলো হয়তো কখনোই পূরণ হবার নয়।
আর কথা না বাড়াই…..বরং শুরু করি…
আমার জন্ম হয়েছিল খুবই সুন্দর একটা গ্রামে, সেখানেই চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত থাকি। এরপর নবম শ্রেণী পর্যন্ত আমার বিভিন্ন হোস্টেলে কাটে। যে ঘটনাটি দিয়ে শুরু করছি, আমি তখন খুবই ছোট! সম্ভবত প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি।
আমাকে প্রাইভেট পড়ার জন্য পাশের এক চাচাতো ভাইয়ের কাছে দেয়া হয়েছিল, ওনার নাম সিয়াম। উনি তখন দশম শ্রেণীতে ছিলেন। প্রথম প্রথম ভালই পড়াতেন, কিন্তু ধীরে ধীরে উনি আমার সাথে অশোভন আচরন করা শুরু করলেন, কিছু অশ্লীল কথাও বলতেন! একপর্যায়ে এসে তিনি আমাকে তার গোপনাঙ্গও দেখাতেন।
খুব ভয় পেতাম আমি! রাতে ঘুমাতে পারতাম না। উনি আমার সাথে এই কাজগুলো করে নিজেই আমাকে ধমকি দিত এই বলে যে, আমি যদি আমার বাবা মাকে এই ব্যাপারে কিছু বলি তাহলে তিনি ওদের বলবেন যে আমি ভাল করে পড়াশোনা করিনা, তাই ওনি আমাকে শাসন করেন বলে তার নামে মিথ্যে কথা বলছি!
আর যেহেতু আমিও খুব ছোট এবং প্রকৃতপক্ষেই অনেক দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম তাই ভয়ে বাবা মাকে কিছু বলতে পারিনি। তবে এরপর একদিন অনেক কান্না করে বাবাকে বলেছিলাম সব, বাবা আমাকেই বিশ্বাস করেছিল। এরপর আমাকে আর সিয়াম ভাইয়ের কাছে পড়তে দেয়া হয়নি, আর বাবা হয়ত তাকে শাসনও করেছিল।
এইবার বলি অন্য ঘটনা, ওইযে সিয়াম ভাই, তারই আপন চাচাতো ভাই নাম আরমান। যে আমার ছোট চাচির ব্যক্তিগত কাপড় চুড়ি করার সময় ধরা খেয়েছিল! সেও সুযোগ পেলেই ঝাপটে ধরতো!
এটাও কিন্তু সেই ছোট বেলারই কথা আপু!
আরমান ভাই একা পেলেই কোন নিরিবিলি যায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য টানতো!
আবার আম্মুর সাথে যখন নানুবাড়িতে যেতাম সেখানেও শান্তি পেতাম না। এক খালাতো ভাই ছিল সেখানে। যার বাবা মারা যাওয়ার পর তারা সবাই নানুবাড়িতেই থাকতো! তিনিও রাতে উঠানে খেলার সময় শরীরের বিভিন্ন যায়গায় হাত দেয়ার চেষ্টা করত! আমার হাত টেনে ধরে তার গোপনাঙ্গে ধরতে বলত, কত কষ্টে ছুটতাম তার কাছ থেকে জানোনা আপু!
সব মিলিয়ে শৈশবটা অনেকটা ভয়ঙ্কর ছিল। এরপর আমিও হোস্টেলে চলে যাই, সেখানে আর কোন সমস্যা ছিলনা। এভাবেই পার হয় বেশ ক’বছর।
যখন আমি ক্লাস নাইনে উঠলাম তখন আমরা প্রথম উত্তরাতে আসি, আমার গণিত শিক্ষক নাম মুরাদ আহমেদ। বাবা তখন সিঙ্গাপুরে থাকেন, আম্মুও তখন উত্তরাতে নতুন। তাই ওই মুরাদ স্যারই আমাদের অনেক সাহায্য করতেন।
আমার ছোট ভাই বোনতে স্কুলে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে, প্রাইভেট টিচার পর্যন্ত, উনিই সব ঠিক করে দিতেন। উনার সাথে এক পর্যায়ে আমাদের পারিবারিক খুবই সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়! স্যার, স্ত্রী এবং ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাসায় প্রায়ই আসতেন।
যখন আমি এসএসসি ক্যান্ডিডেট ছিলাম তখন গণিত মডেল টেস্ট দিতে স্যারের বাসায় যেতাম, আন্ট্য আমাদের সবাইকে অনেক আদর করতেন। সবাই বলতে সেখানে আরও বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীরাও পড়তে যেত।
যাইহোক একদিন স্যার আমাকে পড়ানোর সময় দিলেন বিকেল চারটায়। চারটায় যেয়ে দেখি বাকি সবাই পড়া শেষ করে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি তেমন একটা বুঝতে পারিনি, তবে স্যারকে বললাম আমিও চলে যাই আজকে?
স্যার বললেন ফাকিঁবাজি না করে পরীক্ষাটা দাও এসে। আমিও আর কিছু বলতে পারলাম না। পরীক্ষা দিতে বসলাম, আমাকে প্রশ্ন দিয়ে স্যার ভিতরের রুমে যেয়ে বসলেন, আওয়াজে বুঝতে পারছিলাম যে তিনি কম্পিউটার চালাচ্ছেন। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি যে আন্ট্য আর বাবু তখন বাসায় ছিল না।
আমি যখন মন দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম তখন হঠাৎ করেই স্যার আমাকে ডাকলেন পাশের রুমে যাওয়ার জন্য, বললেন আমাকে তিনি ওনাদের কিছু পুরাতন পারিবারিক ছবি দেখাবেন। আমিও আগ্রহ নিয়ে দেখার জন্য কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি আর সেই মুহূর্তে আমি যা দেখলাম তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না, প্রস্তুত তো দূরের কথা তা ছিল আমার কল্পনাতীত!
সেটা ছিলএকটা ভিডিও, পর্ন ভিডিও! আমি মাটির দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছিলাম এটা কি বাস্তবেই আমার সাথে হচ্ছে নাকি কোন দুঃপ্ন দেখছি! না এটা আসলেই ঘটছে আমার সাথে! ভয়ে আমার হাত পা ঘেমে শীতল হয়ে এসেছিল।
হঠাৎ স্যার আমার দিকে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন, আমি তখন রীতিমত ভয়ে ধরধরিয়ে কাপঁছি! স্যার হঠাৎই আমার গালের দিকে এসে আমাকে চুমু খেতে চাইলেন, ঠিক তখনই আমি দৌড়ে ওঠে পাশের রুমে চলে যাই, আর স্যারও আমার পিছন পিছন ছুটে আসে।
এসে আমার হাত ধরে তার মাথায় নিয়ে বলেন যে “তুমি আমাক কসম দিয়ে বল যে আজকের ঘটনা তুমি তোমার বাবা মাকে বলবানা? আমি কিন্তু তোমার কোন ক্ষতি করতামনা, তোমাকে আমি নিজের সন্তানের মত দেখি।”
আমি তখন রেগুলার “ক্রাইম পেট্রোল” দেখতাম, আমার মনে হল আমি যদি এখন স্যারের সাথে রাগ দেখাই তাহলে তিনি আমাকে মেরে ফেলবেন, তাই মাথা ঠান্ডা রেখে ওনাকে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। অর্থাৎ, উনি আজ যা করতে যাচ্ছিলেন, তার কথা কাওকে বলবো না মেনে নিলাম। এবং সে বাসা থেকে তখনই বের হয়ে গেলাম।
তখন এতটাই আতংক লাগছিল যে, কী করব বুঝতে পারছিলাম না, রিকশা ডেকে তাতে উঠে চুপচাপ বসে রইলাম, রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাব, আমি যেন তখন আমার এড্রেসটাও ভুলে গেছি।
এ ঘটনার পর খুব মানসিক ভাবে ভেংগে পরি, তবে দেরী না করে আম্মুর সাথে শেয়ার করেছিলাম বিষয়টা, আমার আম্মু আর বাবা দুজনেই অনেক কষ্ট পায় শুনে। এরপর থেকে আর স্যারের কাছে না পড়লেও উনাকে আমার আম্মু আর বাবা কেন পুলিশে দেয়নি এটা ভেবে এখনও তাদের উপর আমার রাগ হয়!
সমাজে জানাজানি হবার ভয়ে, বাবা মা রা চেপে যায়। আর এই নরপিশাচরা নিশ্চিন্তে না জানি কত মেয়ের সর্বনাশ করে।
একটা মেয়ে যে কিনা ছোটবেলা থেকেই এইসব বিশ্রি জিনিসের সম্মুখীন হয়েছে তার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারো? আমাদের মা বাবারা আমাদের এই শিক্ষা দেননা যে আমাদের সাথে কেউ এমন করলে আমরা যেন সাথে সাথে তা তাদেরকে জানাই….অথচ এই বিষয়গুলো যে বাচ্চা মেয়েদের সাথে ঘটতে পারে এই ব্যাপরে তারা অবগত থাকলে, কে ভালো কে মন্দ বুঝতে পারতো এবং সাথে সাথে তা মা বাবার সাথে শেয়ার করতে পারতো।
এসব দুর্বিষহ দিন পার হয়ে গেছে, বিয়ে হয়েছে আমার, উত্তম আখলাকের স্বামীও পেয়েছি। কোলে আছে সদ্যজাত সন্তান। কিন্তু এত পাওয়ার পরেও শৈশবের ভয়ংকর স্মৃতি আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। দুঃস্বপ্ন হয়ে যেন ফিরে ফিরে আসে।
তোমাকে কেন এসব বললাম, জানো আপু? কারণ অনেক মেয়ের জীবন কাহিনী এটি।
একটা মেয়ে শিশু অনেক কোমল ও আমাদের সমাজ প্রচণ্ড শ্বাপদসংকুল। মা, বাবা ছাড়া কারো হাতে কণ্যারা নিরাপদ নয়। তাই কেউ যতই আপন হোক, মেয়ে শিশুকে তাদের কাছে একাকী যেতে দিতে হয় না, খালাতো ভাই, গৃহশিক্ষক, কাজের ছেলে…. কারো কাছে না….
আজ অনেক কথা বলে ফেললাম আপু। মন কিছুটা হালকা হলো। আমি চাই, তুমি আমার না বলা কথাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। যেন আমার মত শৈশব আর কাওকে পেতে না হয়।
ভালো থেকো,
তোমার আদরের তাহিরা।
বিদ্রঃ উপরে বর্নিত প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র সত্য। তাই ছদ্ম নাম ব্যাবহার করা হয়েছে।
না বলা কথাগুলো….
তাহিরা
জুলাই ১৬, ২০১৯ইং