ফজরের সলাত পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে সুহা। আকাশটা এখনো গাঢ় অন্ধকার। কিন্তু স্নিগ্ধ বাতাসের মিষ্টি ঘ্রাণই জানান দিচ্ছে ভোরের আবির্ভাব। ব্যস্ত শহরটা এখন গভীর ঘুমে স্তব্ধ।
নিজেকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচে সৌভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে সুহার। কিছুদিন আগেও এইসময় সে ঘুমাতে যেত। আর আজকে অনেক সাধ্যসাধনা, অনেক অনেক দুয়ার পরে আযানের আগেই ঘুম ভেঙে গেছে তার।
মন চাইছে শহরের সবাইকে ডেকে বলে, ওঠো ওঠো, ফজর ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শহর তো দূরে থাক, নিজের বাসার মানুষগুলোকেও ডাকার সাহস নেই তার। দ্বীনের পথে আসার পরে সে যাই করে তাই সন্দেহজনক লাগে তার বাসার মানুষগুলোর কাছে। যদিও জন্মসূত্রে তারা সবাই মুসলিম।
কুরআন পড়ছিল সে মাগরিবের পর। অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া পেল।
-সুহা, মা, কার সাথে মিশছিস তুই? কোন দলের সাথে জড়িয়ে গেলি? কে তোর ব্রেইন ওয়াশ করছে সত্যি করে বল। ধর্ম কর্ম তো আমরাও করি। কিন্তু এতো কম বয়সে এসব কি?
বলছিলেন সুহার বাবা, আব্দুর রাজ্জাক সাহেব।
জবাব মুখে আসেনি।
সুহার বাবা একজন উদারমনা, আধুনিক, বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ। বই পড়ার অভ্যাস সুহা তার বাবার কাছেই পেয়েছে। প্রতিমাসেই গাদাগাদা বই কিনে দিতেন মেয়েকে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব। শরৎ, রবীন্দ্র, বংকিম থেকে শুরু করে লরা ইংগেলস, পার্ল এস বাক, সিডনি শেলডন পর্যন্ত। মেয়ের মানসিক বিকাশে খরচ করতে কখনো কার্পণ্য করেননি তিনি। কিন্তু আজ যখন সুহা দ্বীন নিয়ে পড়া শুরু করেছে, কুরআন-হাদীসের বইয়ে মুখ গুঁজে রাখছে, না চাইতেই ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছে তার। এত অল্পবয়সে এসব কি!!
জোর করে মাথা থেকে এসব চিন্তা তাড়ালো সুহা। আজকে তার জন্য খুবি স্পেশাল দিন। আজকে সে প্রথম হিজাব করবে। বসুন্ধরা থেকে চুপিচুপি একটা স্কার্ফ কিনে এনেছে সে। বাসার কেউ জানেনা। জানলেই শোরগোল পাকাবে।
সে ভেবে রেখেছে কিভাবে কি করবে। বাসা থেকে বের হয়ে লিফটে উঠেই সে স্কার্ফটা বাধবে। আবার বাইরে থেকে এসে লিফটে করে উপরে ওঠার সময় খুলে ফেলবে। বাসার কেউ জানবে না।
পর্দা করা ফরজ। না করে উপায় নাই। কিন্তু বাসায় সে এটা বোঝাতে পারবেনা কিছুতেই।
…………
-কই যাচ্ছিস?
বের হওয়ার মুখেই প্রশ্ন। আগে এসব এত কড়াকড়ি ছিল না।
-কুরআন ক্লাসে।
-কিসের ক্লাস? কুরআন? মানে? তুই তো কুরআন খতম দিয়েছিসই ফাইভে থাকতে। তোর হুজুরের কাছে।
-না না, খতমের জন্য না। শুদ্ধ উচ্চারণটা শেখার দরকার।
কথার মাঝেই সুহার ছোট ভাই অনিকের প্রবেশ।
-মা টাকা দাও। আজ সামিয়ার বাসায় দাওয়াত। একটা গিফট কিনবো সবাই মিলে।
কথা না বাড়িয়ে এক হাজার টাকার একটা নোট দিয়ে দিলেন সুহার মা, মিসেস নীপা।
মনেমনে ভেবে ওঠে, কুরআন ক্লাসের জন্য এত প্রশ্ন। তার দশটার একটা প্রশ্নও যদি এইসব ফ্রি মিক্সিং পার্টির জন্য হতো। জাহিল আমলে মুখেই বলে দিতো। কিন্তু এখন সে জানে, বাবা মা কতটা সম্মানিত।
আরও কিছুক্ষণ জেরার পর মুক্তি পেলো সে।
তাজবীদের ক্লাস হবে আইশা আপুর বাসায়। দেরি করলে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। কিছুই ধরতে পারবেনা।
………
আইশা আপুর বাসায় ঢুকতেই মনে মনে চুপসে গেল সুহা।
সবাই কি সুন্দর কালো বুরকা-নিকাব পরে এসেছে। যেন নারী সাহাবীদের আসর। নিজেকে নর্দমার কীট বলে মনে হচ্ছে। অবচেতন ভাবেই জামার নিচটা টানাটানি করে। গায়ের ওড়নাটা আরেকটু চওড়া করার চেষ্টা করে। যেন হাতের টানাটানিতেই গায়ের জামাটা বুরকা হয়ে যাবে।
কয়েকজন দ্বীনি বোন একসাথে কি নিয়ে হাসাহাসি করছিল। কাছে যেয়ে সালাম দেয় স্নেহা।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুমুস সালাম।
হাসিমুখেই ওর সালামের জবাব দেয় মেয়েগুলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে যায় আবার। নিজেকে খুব লেফট আউট ফীল হয় সুহার।
………
-মা শা আল্লাহ সুহা!! হিজাব শুরু করসো?
আইশা আপুর কথায় বুকটা ভরে যায় সুহার।
-ইয়ে, মানে, হ্যা আপু। আপনাদের মত পারিনাই এখনো। দুয়া কইরেন।
-অবশ্যই দুয়া করবো। কি যে ভালো লাগছে আমার।
-আপু, এভাবে পর্দা করলে কি হবে?
দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে না বোঝান আপু।
-জিলবাব বলা হয়েছে কথাটা। আউটার গার্মেন্টস।
হেসে দেয় সুহা। তারও মনে তাই বলছিল। ফিতরাত।
………..
বাসে উঠতেই মনেমনে চুপসে যায় সুহা। পাব্লিক ট্রান্সপোর্ট একদম ভালো লাগেনা তার। কিন্তু ইদানীং বাসা থেকে সব কিছু এত কড়াকড়ি, টাকা চাইতেও ভয় লাগে তার। শেষে হয়ত মানাই করে দিতো কুরআন ক্লাসে যেতে।
বসার সিট খালি নেই একটাও। সামনের দিকেই একটা সীটে অল্পবয়সী দুজন ছেলে বসে আছে। এদের একজনের মুখে দাড়ি,মাথায় টুপি। অন্যজনের পোশাক আধুনিক।
-হুজুর, দ্যাখ। হুজুরাইন উঠসে। সীট ছাইড়া দে।
-কিসের হুজুরাইন। হাল ফ্যাশনের স্কার্ফী। ঢং করতে মাথায় ত্যানা পেচাইসে। এগুলির জন্যেই ইসলামের নাম খারাপ হয়।
কথাগুলো সবই কানে এসেছে সুহার। দুমড়ে মুচড়ে আসা কান্নাটা চাপিয়ে জোর করেই হেসে ফেললো সে। বলে উঠলো, আলহামদুলিল্লাহ। সেখানে তারা কোন অসাড় কথা শুনবে না।
………..
নওমুসলিমাহ
নূরুন আলা নূর