১
তমালের মায়ের মেজাজ চরম গরম, ছেলের মা বলে কথা। বড় বোনটাও মুখ ভার করে বসে আছে। একমাত্র ছেলের বিয়ে। সবকিছু তার ইচ্ছায় হবে সেটা বলার কি আছে? কিন্তু এখানে তো মনে হচ্ছে তার কোন পাত্তাই নেই। নিজের ছেলেটা এখনি হবু শ্বশুরের হ্যাঁ তে হ্যাঁ, না তে না মেলাচ্ছে। মানা যায়!
মাত্র ৫০ হাজার টাকা দেনমোহর! কি জানি এ বাড়ির মেয়েদের দাম এত্ত কম! যেন আশেপাশে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল। তমালের বাবা একবাক্যে রাজি। ভদ্রলোক বিষয়টা ভালো বোঝেন, মেয়ের বাবা যখন নিজে থেকেই কম দেনমোহর চাচ্ছেন, বুঝেই চাচ্ছেন। শুধুশুধু দরদাম করে অংকটা বাড়ানোতে প্রেস্টিজ বাড়েনা ; এই সেন্স সবার নেই।
অনেকের নিকাহনামায় দেনমোহর শুধুই একটা বিশাল নাম্বার, জ্বী, নাম্বার। সেটা পিছনে ইচ্ছামত জিরো বসিয়ে তাকে বাড়াতে বাড়াতে কোটিতে নিয়ে নিজেদের আভিজাত্য বাড়ানোই কারো উদ্দেশ্য। যাতে করে দেনমোহর শোধ করা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়ে, যদিওবা আপনার শোধ করার ইচ্ছা থাকে।
ইদানীং অনেকেই দেনমোহর শোধ করতে চান, কিন্তু কোন একপক্ষের অতি বৃহৎ নাম্বার প্রীতির কারনে আশাভঙ্গ হয়। সেদিন এক বিয়েতে মাত্র ১০ লাখ টাকা দেনমোহর করা হয়েছে বলে মেয়ের বাবা নাকি লজ্জায় কাউকে বলতে পারেননি! যদিও পুরোটাই শোধ করা হয়েছে, তাদের এখানে কোটির নিচে নাকি দেনমোহর হয়ই না; সেটা শোধ করা হোক বা না হোক।
যাই হোক, ওদের দেনমোহর নিয়ে তমালের মা, বোন নাখোশ। ওদের বাড়ির বুয়ার মেয়ের বিয়েতেও দেনমোহর ২ লাখ টাকা ছিল, আর তার ছেলের বিয়েতে ৫০ হাজার! ভদ্রমহিলা দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলেন। ২০ লাখের নিচে দেনমোহর হলে বিয়ে হবে না। কিন্তু এত টাকা শোধ করা তার ছেলের কম্ম নয়। কিন্তু দেনমোহর এর কম হওয়া যাবেনা। মোহর বিনা উসুলেই বিয়ে হল।
২
সুমির দেনমোহর ছিল মাত্র ৫০ হাজার টাকা।
সে বিয়ের সাথে সাথেই টাকা পেয়ে যায়। এবং এই টাকার সাথে আরো কিছু টাকা মিলিয়ে স্বামীর কাছেই দেয়। শর্ত তাকে হজ্জে নিয়ে যেতে হবে। কয়েক বছর পর তারা সত্যিই হজ্জ করতে যায়, আলহামদুলিল্লাহ।
মাত্র ৫০ হাজার টাকা কিন্তু আল্লাহ এই টাকার মধ্যে কতটা বরকত রেখেছেন নিজেই ভেবে দেখুন। আপনার কয়েক লাখ টাকার দেনমোহর এর চেয়ে এই টাকাটা শুধু দুইটা শুন্য কম, সত্যি সত্যিই শুন্য কম। কাবিননামার সৌন্দর্য বর্ধন ছাড়া আর কি কাজে লেগেছে শুন্য দুটো?
অল্প দেনমোহর শুনে যারা চোখ উল্টাচ্ছিলেন, তাদের জিজ্ঞাসা করি,
আপনার দেনমোহর কত?
কত টাকা উসুল পেয়েছেন, কি করেছেন সেই টাকা?
যারা কোন টাকা পাননি, তারা এত বড় অংকের দেনমোহরের জন্য আলাদা কি কি ফায়দা পাচ্ছেন বা পাবেন বলে ভাবছেন ?
যারা বড় অংকের মোহর নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নিচ্ছেন, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা, অর্থ আপনাকে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম? যদি ধরে নিলেন, এই টাকা আপনাকে ডিভোর্স থেকে বাঁচাবে? স্বামী শোধ করার ভয়ে ডিভোর্স দিতে পারবেনা। তাহলে খুব ভুলের ভিতরে আছেন। অর্থের জন্য যদি কেউ সংসার টিকিয়ে রাখে সেটা আর সংসার থাকেনা, জেলখানা হয়ে যায়।
আর যারা বড় অংকের দেনমোহর নগদ পেয়েছেন সেটা কি করেছেন? সেটা কি শুধুই আপনার ব্যাংক ব্যালেন্সকে বাড়িয়েছে? শুনুন আপারা, যারা প্রচুর টাকার দেনমোহর (গহনা/টাকা) পেয়েছেন তাদের উপর ২ টা ফরজ ইবাদাত অত্যাবশ্যক হয়ে গেছে।
১। যাকাতঃ আপনার মোহর সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ন /সমপরিমাণ অর্থ হলে যাকাত ফরজ হবে যদি সেটা এক বছর আপনার কাছে থাকে। আপনার কোন ইনকাম না থাকলে/ স্বামী স্বেচ্ছায় দিতে রাজী না হলে আপনাকে নিজের যাকাত নিজেকেই দিতে হবে; প্রয়োজনে গহনা বিক্রি করে হলেও, না হলে গুনাহগার হবেন।
২। হজ্জ: অন্তত ৩-৪লাখ টাকার (সম্পদ) মালিক হওয়া মাত্র আপনার হজ্জ ফরজ হয়ে গেছে। মহিলা হিসেবে এক্সটা শর্ত আপনার মাহরাম থাকতে হবে। আপনার যদি অন্য কোন টাকা নাও থাকে, এই দেনমোহরে টাকা দিয়েই যেতে হবে। হজ্জ পালনেও গাফিলতি করার সুযোগ নেই।
অর্থাৎ, দেনমোহর পেয়ে অনেক আনন্দিত হয়ে আমরা যেন নিজেদের উপর আসা নতুন দুটি ইবাদাতের ব্যাপারে গাফেল না হই।
দেনমোহর একটা মেয়ের অধিকার, সেটা বিয়ের সাথেসাথেই শোধ করে দেয়াই কাম্য। সামাজিক স্ট্যাটাস বজায়ের জন্য শুধু শুধু এর অংকটা বাড়ানো উচিৎ না। এতে স্বামী বেচারার উপর চাপ পড়ে, শোধ না করলে পাপ পড়ে। নতুন জীবন কেন বেচারাকে পাপে/চাপে ফেলে শুরু করবেন?
অনেকে বাসর রাতে স্ত্রীর কাছে দেনমোহর মাফ চান। অনেকে মাফ করে দেন; জানিনা এতে মাফ হয় কিনা। মাফই যদি করবেন তাহলে কিছু কমিয়ে নিলে আপনার ক্ষতি কি? চাহিদামত দেনমোহর শোধ করতে পারবেন না বলে অনেক পুরুষ বয়স হয়ে যাবার পরেও বিয়ে করতে পারছেন না। আবার সবকিছু পছন্দ, কিন্তু দেনমোহর নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় বিয়ে ভেঙে যেতেও দেখেছি।
দেনমোহরে অতিরিক্ত শুন্যের ছড়াছড়ি, একধরনের বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু লাগেনা আমার কাছে। এটা সহনীয় পর্যায়ে রাখলেই সবার কল্যাণ। অবিবাহিত বোনেরা, আশাকরি বিষয়টা মাথায় রাখবেন।
……………………
বি.দ্র: আরবি মাহর (مهر) শব্দটিকে বাংলায় বলা হয় মোহরানা বা দেনমোহর (যে মোহর দেনা হিসেবে থাকে)। একজন মুসলিম পুরুষ একজন মুসলিমাহকে বিয়ে করতে হলে তার নিজের সামর্থ্য অনুসারে যে অর্থ বা সম্পদ বিয়ের কনেকে দিয়ে থাকে তাকে মাহর বলা হয়। মাহর অবশ্যই বরের সামর্থ্য অনুযায়ী হবে।
একজন নিম্ন আয়ের বর অতিরিক্ত মাহর লোক দেখানোর জন্য নির্ধারন করে থাকে, পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে নয়। এটা যেমন অনুচিত — ঠিক তেমনই একজন অবস্থাপন্ন বর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কম পরিমাণ মাহর দিয়ে কনেকে ঠকানো অনুচিত। এতে কনের হক্ব নষ্টের কারণে গুনাহগার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
فَمَا اسْتَمْتَعْتُم بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَاضَيْتُم بِهِ مِن بَعْدِ الْفَرِيضَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا [٤:٢٤
অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা গ্রহণ করবে, তাকে তার নির্ধারিত হক দান কর। তোমাদের কোন গুনাহ হবে না যদি নির্ধারণের পর তোমরা পরস্পরে সম্মত হও। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, রহস্যবিদ। [সূরা নিসা-২৪]
– এডমিন
———————
দেনমোহর কি শুধুই সংখ্যার আভিজাত্য
ফাহমিদা হুসনে জাহান