আমার মনে আছে কিশোরী বয়সে একবার ঈদের দিনে ঈদের খুশিতে নামায পড়িনি। মানে ঈদ তো, সব কিছু থেকে যেন ছাড়! অদ্ভুত ছিল ওই সময় উৎসব সম্পর্কে ধারণা। মনে করতাম ঈদের দিন মানে বাধাহীন আনন্দ, কোন দায়দায়িত্ব নেই।
আমরা বড় হতে হতে এই ধারণার বিস্তৃতিও বেড়েছে। উৎসবের দিন দায়িত্ববোধ তলানিতে এসে ঠেকেছে। “Hedonism” বলে এক নতুন মতবাদের প্রচলন আমাদের সমাজেও দেখতে শুরু করেছি যেখানে মানুষ যে কোন উপলক্ষে শুধু বিনোদন খোঁজে, নিজের প্রবৃত্তিকে তৃপ্ত করে। ধীরে ধীরে ঈদ, পহেলা বৈশাখ, নিউ ইয়ার, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, একুশে ফেব্রুয়ারী সব একই রূপ ধারণ করেছে। অপ্রয়োজনীয় খাওয়া-দাওয়া, কারনে অকারনে সেলফি তোলা, অপরিহার্যভাবে সেসব ফেসবুকে আপলোড করে সবাইকে দেখানোর মাধ্যমে শো অফ, বিলাসিতা, শালীনতা হারানো এসবকিছুই উৎসবের অংশ এখন। কখনো লাল-সাদা, কখনো কালো-সাদা, কখনো বাহারি সাজে সেজে একেক উৎসবে একেক লুক এনে পুরনো জিনিসকে নতুন করে উপস্থাপনের চেষ্টা থাকে মেয়েদের মাঝে। ছেলেদের মাঝে থাকে অনর্থক প্রতিযোগিতা আর নারীসঙ্গ পাওয়ার আরেকটি সুযোগ।
শুধু যে বিষয়টা সবাই বুঝেও বুঝে না, দেখেও দেখে না সেটা হচ্ছে এসব উৎসবের পেছনে থাকা বিশাল ব্যবসায়িক লাভ। ফেব্রুয়ারিতে একবার বাসন্তী কাপড়, একবার লাল আরেক বার কালো কাপড় কেনার দুই মাসের মাঝেই আবারও লালা-সাদা কাপড় চাই। সাথে লাল-সাদা গয়নাও লাগবে। এর এক মাস পরই হাল ফ্যাশনের ঈদের জামা কেনার ধুম পরে যায়। অভিজাত শপিং সেন্টার থেকে পাড়ার রাস্তার ভ্যান গাড়িতে পর্যন্ত থাকে এই ব্যবসার ছায়া। খাবারের দোকান, প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়াও চুটিয়ে ব্যবসা করে নেয়। আমরা যত উৎসব করবো ওরা তত ব্যবসা করবে। আমরা যত অকারণ টাকা খসাবো ওরা তত লাভ করবে। আর তাই উৎসবের সংজ্ঞাও আমাদের কাছে ওরাই ঠিক করে দিয়েছে – প্রয়োজন ছাড়াও খরচ করা, অতিভোজন, অসুস্থ সামাজিক প্রতিযোগিতা করা আর অশ্লীলতার প্রচার প্রসার – এই তো এখন আমাদের উৎসব, তাই না?
অনেকগুলো বছর লেগে গেছে আমার এটা বুঝতে যে আল্লাহ্ উৎসব বলতে আমাদের কী দিতে চেয়েছেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় যাওয়ার পর বলেছেন আমাদের মুসলিমদের শুধু দুইটা উৎসব, দুই ঈদের দিন। আমাদের জন্য ঈদের সালাত বলেও একটা আলাদা সালাত আছে। আমাদের উৎসবের দিন শুরু হয় এই সালাত দিয়ে। আর কোন উৎসবে কি আমরা আল্লাহকে স্মরণ করে দিন শুরু করি? আমাদের উৎসবে ইবাদাত জড়িত থাকে, মূলত ইবাদাতই আমাদের উৎসবের প্রাণ। কুরবানী ঈদে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করি। আগে থেকে দেখেশুনে ভালো পশুটা কিনতে চেষ্টা করি। জবাইয়ের পরও সেটা একা না খেয়ে অন্যদের দিয়েও খাই। এসবকিছুই আমাদের কাছে খুশির কারণ।
আর ঈদুল ফিতরে? আমরা পুরো এক মাস সিয়াম পালন করে আশা করি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছি, লাইলাতুল ক্কদর তালাশ করে করে বেশি বেশি ইবাদাত করে আশা করি আল্লাহ্ আমাদের ভাগ্যে ভালো কিছু লিখে রেখেছেন আগামী বছরের জন্য। আমরা আল-‘আফুউকে বার বার ডেকে ডেকে আমাদের ক্ষমা করে দিতে বলেছি এমন সব সময়ে যখন দু’আ কবুল হয়। আমরা যাকাতুল ফিতর আদায় করে অন্যের সাথে খুশি ভাগ করে নিয়েছি, সাদাকা করার সাওয়াবের আশা করেছি। আমাদের রবের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ হিসাবে রামাদানের মতো এত বরকতময় এক সময় আমরা পার করেছি তাই মনে আশা নিয়ে আমরা খুশি হই। সেই সুযোগকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের আনন্দ হয়, আমরা ঈদ করি। আমরা একে অন্যকে বলি, “তাকাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম”, মানে আল্লাহ্ আমাদের ও তোমাদের ভালো আমল কবুল করে নিন।
আমরা তখনই উৎসব করি যখন আমরা আশা করি এমন কিছু করতে পেরেছি যাতে আল্লাহ্ আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন!
উৎসবের বাণিজ্যিকীকরণের ঠিক বিপরীত চিত্র আমাদের ঈদ।
এই রামাদানে একজন বয়োজ্যেষ্ঠা ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই উনার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কথা বন্ধ হওয়ার আগে উনি উপস্থিত মানুষদের উদ্দেশ্য করে একবার বলেছিলেন, “তোমরা সরে যাও, ফেরেশতারা আসছে। তাদের আসতে দাও।” আমার যেন কল্পনায় ভাসছে উনার মৃত্যুর পর ফেরেশতারা প্রতি আসমানে উনাকে নিয়ে যাচ্ছেন। আসমানের দরজায় কড়া নাড়ার পর জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, কে এসেছে? উনার নাম বলা হচ্ছে আর তখন ওই আসমানের ফেরেশতারা উনাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি বয়স্কা মানুষটা ফোকলা দাঁতে বাচ্চা মেয়েদের মতো তিরতিরে খুশি নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে এক আসমান থেকে আরেক আসমানে উড়ে উড়ে যাচ্ছেন। আহ কী শান্তি, যেখানে আমার রবের সন্তুষ্টির আশা আছে!
আমাদের কাছে সেটাই তো ঈদ।
উৎসব মানে
রাবেয়া রওশীন
জুন ০৭, ২০১৯ইং