১.
স্বাতী বাবা মার একমাত্র মেয়ে। খুব আদরেই বড় হচ্ছিল ছোটবেলায়। সুন্দর ছিমছাম জীবন। স্কুলে ভাল ছাত্রী, কবিতা আবৃত্তিতে তুখোড়, এমনকি বিতর্ক প্রতিযোগিতাতেও সেরা বক্তা হয় অহরহ। ছুটি ছাটায় বাবা সিলেট, কাপ্তাই কিংবা রাঙামাটি নিয়ে যান। এরকম নিশ্চিন্ত জীবনে ঝড় ওঠে যখন প্রথমে মা চলে যান পরপারে। কিছুই না, আচমকা স্ট্রোক করে মা হাসপাতালে, সেখান থেকে আর সুস্থ হয়ে ফেরেননি। তখন স্বাতীর তেরো বছর বয়স। তার তিন বছর পর বাবাও। মনে হয় মা’র চলে যাওয়াটা বাবার সহ্য হয়নি।
অল্প বয়সে বাবা মা হারানোর ব্যপারটা স্বাতীকে এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সে বুঝতে পারে পৃথিবীতে কোন কিছুই স্থায়ী নয়। সুখ, সে তো সবচেয়ে পলকা জিনিষ। এখানে কারো উপরই ভরসা করে নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করা যায় না, চাই সে বাবা কিংবা মা-ই হোক না কেন! ভরসা যদি করতে হয় তবে তা আল্লাহ্র উপরই করতে হবে। তিনিই মানুষকে সবসময় দেখে রাখেন। মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। আর ভালবাসেন বলেই মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করেন তাকে খাঁটি করে তোলার জন্য। স্বর্ণ যেমন করে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয় ঠিক তেমনি করে। তবেই তো মানুষ ওপারে গেলে পুরস্কৃত হতে পারবে। সুখের নিশ্চিত এবং স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পাবে। বাবা মা হারিয়েও স্বাতী অদ্ভুত এক মনের জোর পেল বেঁচে থাকার। পুরোপুরি ভরসা করতে শিখল আল্লাহ্র উপর। বিশ্বাস করতে শিখল যে তিনি যা-ই করেন, তার কল্যাণের জন্যই করবেন।
বাবার কাছের বন্ধু জুনায়েদ চাচা ভালবেসেই দায়িত্ব নেন স্বাতীর। কিন্তু বাদ সাধেন চাচী। তিনি ওকে সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু এ নিয়ে বেশি কিছু বলতেও পারতেন না, কারণ চাচার কাছে খারাপ হওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁর আড়ালে স্বাতীকে কথা শোনাতেন চাচী। তাতে স্বাতী কষ্ট পেত না, বরং মনে হতো, তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে অনেকেই, সে তো তবু চাচার সংসারে থাকছে। তার বরং উচিত চাচার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।
চাচার মেয়ে নাবিলা স্বাতীকে বেশ পছন্দ করত। নাবিলার ভাই, তমাল; সে বরাবরই ভাবলেশহীন। পছন্দ অপছন্দ কোনটাই বোঝা যেত না। মাঝে মাঝে মনে হত তমাল ওকে করুণা করছে। তবু এই করে স্বাতীর পাঁচ বছর কেটে গেল জুনায়েদ চাচার সংসারে।
২.
স্বাতীর শান্ত-শিষ্ট স্বভাব, ভাল ছাত্রীত্ব, বিনয়ী কথাবার্তা মুগ্ধ করে অনেককে। ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার কিছুদিন যেতেই একটা ভক্তকুল তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু কেউ মুখফুটে বলার সাহস পায় না, এমনি তার ব্যক্তিত্ব। তাছাড়া সবাই জানতো স্বাতীকে কারো ভাল লাগে এটা শুনে তার কোন প্রতিক্রিয়া হবে না কারণ সে আর দশটা মেয়ের মত নয়।
এমনি করে দিন চলে যাচ্ছিল। একদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটে বড় চাচার পরিবারে। তমাল একটা রোড এক্সিডেন্টের শিকার হয়। তার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে যায়। অনেকদিন চিকিৎসা করার পরও তাকে বরণ করে নিতে হয় অন্ধত্ব। অথচ সে তখন কেবলি চাকরি জীবনে প্রবেশ করেছে। সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ। চোখ হারানোর পর জানা গেল, সে যে মেয়েটিকে পছন্দ করত এবং বিয়ে করবে বলে তৈরি হচ্ছিল সে মেয়েটি এখন আর তাকে বিয়ে করতে রাজি নয়। মেয়ের পরিবার থেকে দুজনের মধ্যকার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলা হয়েছে কড়াকড়িভাবে।
এসব ব্যাপার স্বাতী জানতে পারল নাবিলার কাছে। জুনায়েদ চাচার পরিবারে সবার মন খারাপ। বিশেষ করে চাচীর। বাসার পরিবেশ গুমোট হয়ে থাকল বেশ কিছুদিন। স্বাতীর খারাপ লাগছিল খুব, কিন্তু দুআ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।
৩.
এর মধ্যে স্বাতীর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেল। মোটামুটি কোমর বেঁধে পড়াশোনা করছে সে। একদিন চাচা এলেন তার সাথে কথা বলতে। একথা সে কথার পর মূল প্রসংগে এলেন।
“মা, তমালের অবস্থা তো জানো। আমরা ওকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছি। তোমার চাচীকে তো দেখছ! ছেলের কষ্ট সইতে পারছেন না। একেতো ছেলেটা এক্সিডেন্ট করল, দুটো চোখ চলে গেল। তার মধ্যে ঐ মেয়েটাও ওর জীবন থেকে চলে গেল! খুব ভেঙে পড়েছে। ওর মা’র মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছ হয়তো। তিনি আমাকে খুব জোর করছেন কদিন ধরে তোমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে। তুমি কি আমার ছেলেটার সংগে বাকি জীবন কাটাতে পারবে?”
স্বাতী কি বলবে ভেবে পেল না। সে চুপ করে রইল। জুনায়েদ চাচাও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। পরে বললেন, ‘ঠিক আছে তুমি ভেবে দেখ, সময় নাও। যদি আপত্তি না থাকে তবে তোমার পরীক্ষার পর আমরা আনুষ্ঠানিকতাটা সেরে ফেলতে পারি।’ এই বলে তিনি ধীরপায়ে চলে গেলেন।
স্বাতী প্রথম রাতে খুব কাঁদল। পুরো রাত ঘুমাতে পারল না। কেন কাঁদল তাও সে পুরোপুরি বুঝল না। তমালের একটা মেয়ের সাথে মন বিনিময় হয়েছে সে কারণে নয়, ওর চোখ দুটো চলে গেছে সে কারণেও নয়। তমালের তার সম্পর্কে কি মনোভাব তা তার অজানা। তবু চাচী কি মনে করে তাকেই তমালের পাত্রী নির্বাচন করলেন সেটাই সে বুঝতে পারছে না। কান্নাটা হয়ত এই কারণেই এসে থাকবে। চাচী হয়ত ভাবছেন তার অন্ধ ছেলের জন্য এখন মেয়ে পাওয়া কঠিন হবে। হাতের কাছেই যখন একটা মেয়ে আছে! এই ভাবনাটুকুই স্বাতীকে কষ্ট দিচ্ছিল! মানুষের স্বার্থপর চেহারা কল্পনা করতে তার ভাল লাগে না।
পরদিন থেকে স্বাতী নিজেকে বোঝালো। চাচাকে মুখের উপর না বলা যায় না। সে পারবে না। তাছাড়া সারাজীবন চাচীর দু’চোখের বিষ হয়ে থাকাও সম্ভব নয়। তার চেয়ে আল্লাহ্র কাছে চাওয়া যাক। তারা যেহেতু এমন চিন্তা করছেন, তমালের মতামত নিয়েই করছেন। কাজেই ধরে নেয়া যায় এরকম সম্পর্কে ওর মত আছে। কিন্তু স্বাতীর যেমন পাত্র চাই তমাল তেমন নয়। স্বাতীর মত ও আল্লাহ্র উপর ভরসা করতে পারে বলে কখনো মনে হয় নি। প্র্যাক্টিসিংও নয় খুব একটা, যদিও খারাপও নয় মানুষ হিসেবে। স্বাতী আল্লাহ্র কাছেই চাইতে থাকল সবসময়, রাত- দিন। তিনি যেন এই সমস্যার সহজ সমাধান দেন। তমালকে যেন তিনি সঠিক পথ দেখান। আর তাকে যেন ধৈর্য ধারণ করার শক্তি দেন।
৪.
চোখ কান বন্ধ করে পরীক্ষাগুলি দিয়ে ফেলল স্বাতী। তারপর অফুরন্ত অবসর এবং অপেক্ষার পালা। তমালের সাথে তার কথা হয় না। আগে কখনো কখনো চোখ দেখাদেখি হত, এখন সেটাও বন্ধ। চাচী আজকাল তার সাথে ভাল ব্যবহার করেন। ছেলের একটা ব্যবস্থা করতে পারছেন বলে মনটাও ভাল। দিন তারিখ ঘনিয়ে আসছে। স্বাতী কিছুই ভাবে না, শুধু দুআ করে।
একদিন বাসায় কেউ ছিল না। বিভিন্ন কাজে সবাই বাইরে। স্বাতী নিজের ঘরে, তমাল ওর ঘরে। স্বাতী একটা বই পড়ছিল, এসময় ঘরের দরজায় তমালের গলা –
“আমি কি একটু কথা বলতে পারি তোমার সাথে? কয়েকটা কথা বলার ছিল।”
স্বাতী তমালকে ভেতরে ডাকবে কিনা বুঝতে পারছিল না, সসংকোচে বলল, “বল কি বলবে।”
– “আমি চট করে বলেই চলে যাব। বেশি সময় নিব না। যা বলতে এসেছিলাম তা হল, আমি এই বিয়েতে না বলতে পারতাম, কিন্তু বলি নি। আমাকে কেউ জোর করে নি। আমি নিজেই রাজি হয়েছি এবং নিজের স্বার্থেই রাজি হয়েছি। আমি জানি আমার টেক কেয়ার তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ-ই করতে পারবে না। তুমি এই ফ্যামিলির আদ্যোপান্ত জানো, আমাকেও জানো। মা এই ব্যাপারটা সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারছেন এবং মা’র ইচ্ছেটা আমি বুঝতে পারছি।”
– “হুম।”
– “আমি জানি তুমি হয়ত বাবাকে কষ্ট না দেবার জন্য মেনে নিচ্ছ সব। তোমার কাছে একটা ব্যাপার আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। আমি আমাদের ফ্যামিলিতে তোমার উপস্থিতি প্রথম থেকেই মানতে পারতাম না। তোমাকে বরাবরই ঝামেলা মনে করেছি। আল্লাহ্ বোধহয় সে কারণেই আমাকে এমন শাস্তি দিলেন।
না, অভিযোগ নয়, এটা আমার পাওনা ছিল। আমি তোমার কষ্টটা তেমন করে উপলব্ধি করিনি বরং তুমি আমাদের সাথে আছ, বাবা তোমার দায়িত্ব নিয়েছেন, আমাদের উপর একটা বাড়তি ঝামেলা এসে পড়েছে এমনটাই মনে করে এসেছিলাম কিছুদিন আগে পর্যন্ত।
আমার জীবনে এই ঘটনাগুলো না ঘটলে আমার বোধোদয় হত না। এখন এতকিছুর পরও সে কারণে আমার আফসোসের মাত্রা অনেক কম।”
এই পর্যন্ত বলে তমাল থামল। স্বাতী কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল।
কয়েক সেকেন্ড জবাবের অপেক্ষায় থেকে তমাল আবার বলল, “আমি চাইনা আমাদের সামনের জীবনটা অস্বস্তি আর ভুল বোঝাবুঝি দিয়ে শুরু হোক, এই জন্যেই এই কথাগুলো বলা। আমার বিরূপ আচরণ সত্ত্বেও তুমি আমার সাথে নতুন জীবন শুরু করতে রাজি হয়েছ বলে আমি কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যতে এরকম আর হবে না।”
– “এভাবে বলতে হবে না, আমি ঠিক আছি!” স্বাতী কোনরকমে বলতে পারল। তার খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল।
– “তুমি কিছু বলবে? আমার বলা শেষ।”
– “না। আমার কিছু বলার নেই।”
– “আচ্ছা, তাহলে আমি যাই।” তমালের লাঠি আওয়াজ তুলল।
স্বাতীর কেমন হাল্কা লাগছিল। এতদিন কী যেন একটা দলা পাকানো চাপ অনুভূত হচ্ছিল, এখন সেটা উধাও। ব্যাপারটা আবিষ্কার করে চোখ ছলছল করে উঠল তার। কৃতজ্ঞতায়!
………………………………….
ইহসান
সাইমুনা তারিন
(১৮ জানুয়ারী ২০১৮)