২০১৩ সালের ঘটনা। দ্বীনের পথে প্রত্যাবর্তনের পর সে বছর মার্চ থেকে আমার পর্দা করার প্রাথমিক প্রচেষ্টার শুরু। প্রথমদিকে সাধারণ জামা-পায়জামা, ওড়নার উপর শুধু চুল ঢেকে রাখা হিজাব করা শুরু করি; এরপর ধীরে ধীরে আরো ঢিলেঢালা ফুলহাতা লং ফ্রক টাইপ জামার সাথে মাথা ও শরীরে আলাদা দুইটা ওড়না দিয়ে একটু বেটার পর্দা করার চেষ্টা চলতে থাকে। আর সত্যি বলতে সাজগোজ আমার কোনো কালেও পছন্দ ছিল না – মানে ঠোঁটে, গালে এক্সট্রা রঙ লাগানো। কিন্তু নিয়মিত ব্যবহার না করলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে টিপিক্যাল মেয়েদের মতো হিজাব পরেও সেজেছি তা অস্বীকার করব না( আল্লাহ্ মাফ করুন)। তবে হিজাব করার পর টিপ দেইনি আর কখনো।
অনার্স শেষ করার পর, মাস্টার্স শেষ করার আগে থেকেই স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। বিয়ের পর বাবুর ৬ মাস বয়সে পাকাপাকিভাবে ক্যারিয়ারের ইতি টানি। এরপর ছেলের তিন বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর পুনরায় সেই স্কুল থেকে জয়েন করার প্রস্তাব আসলে ফোনে আমার প্রথম শর্তই ছিল আমাকে হিজাব করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে এবং কেউ ঠোঁটে এক্সট্রা রঙ( লিপস্টিক) লাগাতে বলবে না। আলহামদুলিল্লাহ্, এডমিনের সেই শুভাকাঙ্ক্ষী আপুর কাছ থেকে সে বিষয়ে নিশ্চয়তা পেয়ে নতুন করে রিক্রুটমেন্ট প্রসেসিং-এর সব ফর্মালিটিস শেষে আবার জয়েন করি সেই স্কুলে, কিন্তু মাত্র ৮ মাস আমি জবটা কন্টিনিউ করতে পেরেছিলাম। দ্বিতীয়বারের মতো জয়েন করে, হুট করে জব ছেড়ে দেওয়াটা যে কতটা টাফ আর চ্যালেঞ্জের ছিল আমার জন্যে সেইসব বললে আলাদা আরেকটা গল্প হয়ে যাবে।
যাইহোক, গত রমাদানে জব ছাড়ার আগেই নিয়ত করি যে জব ছেড়ে দিয়েই একবারে বোরকা পড়া শুরু করবো ইনশাআল্লাহ্। নিয়ত মোতাবেক গত ঈদুল ফিতর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বোরকা পরা শুরু করেছিলাম, সে আজ থেকে মাত্র এক বছর আগের কথা। আলহামদুলিল্লাহ্, ঈদের দিনটাকেই আমি বোরকা শুরু করার দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, এরকম জুনের দাবদাহে, প্রচন্ড গরমেই কেটেছিল আমার পর্দা শুরুর দিনগুলো!
যা শুরু করেছি ভালোবেসে মন থেকে নিজের ইচ্ছেতেই শুরু করেছিলাম। শরীরের এসব সামান্য কষ্ট আল্লাহর সন্তুষ্টি আর নিজের মনের ভালোলাগার কাছে তখন ঠুনকো লাগতো।
কিন্তু শারীরিকভাবে আমি কিছু পরীক্ষায় পড়ে গিয়েছিলাম, আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছে হয়তো সেরকমই ছিল। শরীরে শুরু হলো ঘামাচি, গরমে ঘেমে ঠান্ডা লাগা, থেকে থেকে সাইনোসাইটিসের ব্যথা, হরেক রকম এলার্জি থেকে স্কিন প্রবলেম। এতকিছুর পরেও আমি বোরকা ছেড়ে দেইনি।
আলহামদুলিল্লাহ্ তারও প্রায় বছরপূর্তি হয়ে এলো। এবারের গরমেও এলার্জি এখনো পুরোপুরি সাড়েনি। আমি বলবো না বোরকাই আমার অসুস্থতার কারণ। কারণ এলার্জি আমার বংশগত রোগ; আমার মায়ের আছে, আছে আমার ছেলেরও। এসব বলার কারণ যারা বলেন বোরকা পড়লে দম আটকিয়ে আসে, মাথা ঢাকলে মাথা ব্যথা করে, ঘেমে জান বের হয়ে যায়! কথাগুলো তাদের জন্যে বলা। আল্লাহর পথে চলতে গেলে শত কষ্টও হাসিমুখে মেনে নেওয়া যায়। শুরুতে পরীক্ষাগুলো ধৈর্য্যের সাথে পার করতে পারলে পরবর্তীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্পনাতীত সাহায্য এসে যায়।
কে না জানে, এই সামান্য গরমের থেকেও তো জাহান্নামের আগুন আরো উত্তপ্ত, আরো ভয়ংকর! কিন্তু আমরা যা জানি তা বিশ্বাস করি তো, মনে প্রাণে!? আল্লাহ্ মাফ করুন আমাদের।
বিশ্বাস করুন, এতো কিছুর মাঝেও আলহামদুলিল্লাহ্ মনের মধ্যে কী যে এক শান্তি অনুভব করি আজকাল। সেটা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়, কারণ আল্লাহ্ এর রাস্তায় হাঁটার চেষ্টার মাঝে যে কী অকল্পনীয় শান্তি সেটা অনুভবের বিষয়, কাউকে বোঝানোর বিষয় নয়। থেকে থেকে কী যে এক দারুণ সারপ্রাইজের জন্যে মনটা খুশিতে ভরে যায়, কারণ আমি বিশ্বাস করি আমার প্রত্যেকটা ত্যাগ, কষ্ট, অন্যদিকে মানুষের কটু কথা এবং শরীরের প্রতি ফোঁটা ঘামের বিনিময়ে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাকে পরকালে পুরস্কৃত করবেন, অবশ্যই করবেন ইনশা আল্লাহ্।
আমি কোন ব্যক্তিকে খুশি করার জন্যে নয়, কোন ব্যক্তির চাপের মুখে ফরজ বিধানকে উপেক্ষা করে নয়, কারো কথায় Self esteem কে পরিত্যাগ করে নয়, আমার এই যৎসামান্য প্রচেষ্টা তা কেবল আমার রবকেই খুশি করার জন্যে।
হ্যাঁ, আমার এই সামান্য চেষ্টাতেও অনেক ভুলভ্রান্তি আছে, আল্লাহ্ এর রাস্তায় হাঁটার সিঁড়ির প্রথম ধাপটাতেই যে আছি এখনো, এখনো চেষ্টা এবং ভুল, অতঃপর ভুলের পর আবারও চেষ্টার স্টেজে এই অধমের অবস্থান!
তবুও আমার আল্লাহ্ তো তার বান্দার মনের খবর জানেন, তিঁনি জানলেই তো এই বান্দার জন্যে তা যথেষ্ট। আমার রব, যিনি একমাত্র অন্তর্যামী – তিনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ মহান বিচারক!
তাহলে ভয় কি!? তাই না!?
আর যে তার নিয়ত অনুযায়ী চেষ্টা করবে, পরমকরুণাময় আল্লাহ্তা’য়ালা অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন, অবশ্যই।
اللَّهُمَّ يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَى دِيْنِكَ
(আল্লাহুম্মা ইয়া! মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুব, ছাব্বিত ক্বলবী আ’লা দ্বীনিক)
অর্থ: হে আল্লাহ! হে হৃদয়ের পরিবর্তনকারী ! আপনি আমার হৃদয়-কে আপনার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।
……………………….
আলোর পথে যাত্রা
উম্মে সামিয়া আফরিন
জুলাই ১১, ২০১৯ইং