রাত ৯টা।
বাবায়া, পিইইজ বাবা মাকে আর মেলোনা। পিইজ বাবা।
তার ফিসফিস আরমানের কানে পৌছেনি। পৌছালেও কোন লাভ হতো বলে মনে হয় না।
কাঁদতে-কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে আয়ানের। ভয়ে প্যান্টটা পেশাবে ভিজে গেছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে একবার মাকে দেখছে, আবার দৌড়ে পালাচ্ছে।
মায়ায়ায়া হিক…..মাগো… হিক।
মা তুমি ময়ে যেও না। হিক হিক।
খাটের নিচে লুকিয়ে আছে সে। ভয়ে কাঁপছে। বুকটা ফেঁটে যাবে যেন।
-শালী, আমারটা খাস, আমারটা পরোস আর আমার সাথেই ট্যাটনামি করস? এত্ত বাড় বাড়ছিস তুই?
-চিৎকার কর না। আয়ান ভয় পাবে।
-চোপ। বল কই রাখসিস টাকা? বেতন কই?
-বেতন দিবো কেন? বেতন দিলে চলব কিভাবে? আয়ানের খরচ আসবে কই থেকে?
-চোপ। বেতনের টাকা আমার হাতে দিবি। আমি খরচ দিবো যা লাগে।
-বউয়ের টাকা হাত পেতে নাও, লজ্জা লাগে না? ভিক্ষুক কোথাকার।
-কিক? এত্ত বড় সাহস? আমার বাসায় আমারে ভিক্ষুক কস? ফকিরনির ফকিরনি। আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন।
-মাগো। (চাপা গলায় কাঁদে আমরিন)।
……
মধ্যরাত ২টা।
আয়ানের ঘুমন্ত, পেশাবে ভেজা শরীরটা খাটের নিচ থেকে বের করে আমরিন। ঠান্ডা হয়ে আছে বাচ্চার শরীরটা। চোখের পানি গালে শুকিয়ে গেছে। বাচ্চাটাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে। প্যান্ট পালটে দেয়। মুখটা মুছে দিলে ভালো হতো কিন্তু শরীরে কুলাচ্ছে না।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে আসার পর পরই শুরু হয়েছে অশান্তি। টাকা দে টাকা দে। একটা উচ্চ শিক্ষিত ছেলে যে এভাবে টাকার জন্য অশান্তি করতে পারে, নিজে না দেখলে বিশ্বাস করতো না সে।
মাসের শুরু হতেই বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে যায় তার। এই বুঝি শুরু হলো অশান্তি, খিটমিট। আর ভালো লাগেনা।
…………
সকাল ৮টা।
আমরিন চড়া মেকাপ করেছে আজকে। মুখ ফুলে আছে। কিন্তু মেকাপের জন্য চেহারার আসল অবস্থা ঢাকা পরে গেছে। চুল ছেড়ে রাখায় গলা আর পিঠের কালচে দাগগুলোও দেখা যাচ্ছে না।
আরমানের মোটরসাইকেলের সামনে বসেছে আয়ান। পিছনে আমরিন। আয়ানকে স্কুলে নামিয়ে আমরিনকে নামাবে। দু’জনের অফিস কাছাকাছি।
আয়ান রোবটের মত স্থির হয়ে আছে। চেহারায় কোন ইমোশন নেই। আরমানের মেজাজ ফুরফুরে। বেশ কিছু টাকা হাতে চলে এসেছে আমরিনের সুবাদে।
আশ্চর্যজনক ভাবে আমরিনের মুখও স্বাভাবিক। বাসার গুমোট অবস্থা থেকে বের হয়ে তার হাফ ছেড়েছে। অনেক ফ্রেশ আর হালকা লাগছে। অফিসে যেয়ে সহকর্মীদের সাথে হাসি ঠাট্টায় ভুলে যাবে অনেক কিছুই।
………
সকাল ৮:১০
বারান্দা দিয়ে আমরিনের পরিবারের প্রস্থান দেখল জুই।
নিজের অজান্তেই বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসল তার। কেন আসলো নিজেও জানেনা।
দ্বীনের জ্ঞান আসার পর থেকে জুই পর্দা, ফ্রি মিক্সিং এর মত ইস্যুগুলোতে খুব সচেতন। তাই তো নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করেও চাকরির চিন্তা করেনি।
কিন্তু ইদানীং কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয় দিনের কয়েকটা মুহূর্ত নিজের মত করে পাওয়া যেত, ইচ্ছা করলেই হুট করে একটু বেড়িয়ে আসা যেত, এক কাপ চা গরম থাকতেই খাওয়া যেত, এক প্লেট ভাত নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে খাওয়া যেত! উদ্ভট সব ইচ্ছা। এগুলোও যে বিলাসিতা হয়ে যাবে কে জানত।
হাফসা-হুমাইরা তার কলিজার টুকরা। কিন্তু সারাটা দিন যখন এই একটা বাচ্চাদেরকে নিয়েই পরে থাকতে হয়, রিয়েল কনভার্সেশন চালানোর মত কাউকে পাশে পাওয়া যায় না, ঘুম-গোসল-খাওয়ার মত বেসিক কাজগুলোও ঠিক ভাবে করতে পারে না, মাথা আউলা আউলা লাগে।
আগে কখনো পাশের ফ্ল্যাটের আমরিনকে অফিসে যেতে দেখে কিছু মনে হয়নি। কিন্তু আজকাল কেন যেন মনে হয় আমরিন কত্ত স্বাধীন।
…………
সন্ধ্যা ৭:০০
২ বছরের হাফসা পটিতে বসেছে।
পাশেই জুই ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে দুপুরের ভাত খাচ্ছে। পটির গন্ধে ঘর ভরে গেছে। জুইয়ের মুখ নির্বিকার। নাকে মুখে ভাত গিলছে। ক্ষুধায় হাত পা কাঁপছিল। জাহিদ একবার এসে উঁকি দিয়েই খুব ব্যস্ত ভংগীতে গম্ভীরমুখে চলে গেছে। জুই দেখলেই হাফসাকে ধুয়ে দিতে বলবে, তাই।
………….
রাত ১২:০০
অনেক ধ্বস্তাধস্তি শেষে বাচ্চারা ঘুমিয়েছে। জুইয়ের মাথা বনবন করছে। এতক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। বাচ্চারা ঘুমাতেই কেমন যেন শরীর-মন হাল্কা হয়ে গেল, ঘুম পালালো।
দুই কাপ কফি বানিয়ে জাহিদের সামনে এসে বসলো।
-হুজুর।
সম্বোধন শুনেই জাহিদ বুঝে গেছে আবদার আসছে সামনে।
-বলেন ম্যাডাম।
- মামা আসছে দেশে বুঝছো। কাল আম্মার বাসায় সবাইকে ডাকসে।
জাহিদ গম্ভীর হয়ে গেছে। জাহিদের চেহারা দেখেই জুই বুঝতে পারছে কি শুনতে হবে। কিন্তু সে মরিয়া। একটু ব্রেক চাই। চাইই চাই।
-কি হলো বলো?
-কি বলব?
- কি বললাম তোমাকে! সেটার উত্তর দাও রে বাবা।
-জানোই তোমার আম্মার বাসার পরিবেশ। কেউ প্র্যাক্টিসিং না, হালাল-হারাম মানে না।
-আহা। ওরা না মানলে আমাদের কি? ওরা আমাদের তো বাঁধা দিচ্ছে না দ্বীন মানতে। আর মামা তো আমার মাহরাম। ফ্রি মিক্সিং এরও কোন ভয় নেই। - যা বোঝো কর।
-জাহিদ, প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর। আমি সারাদিন বাচ্চাগুলোকে নিয়ে থাকি। কোন এন্টারটেনমেন্ট নেই, কিচ্ছু না। আমি পাগল হয়ে যাবো। - জুই। (দাঁত পিষে বলে জাহিদ)
তোমার বেশি সমস্যা হলে বলে দাও, আরেকটা বিয়ে করে আনি সংসার করতে। তুমি তোমার মত ব্রেক কাটাও।
জুইয়ের মুখে কালি লেপে দেয় কেউ যেন।
……..
ছুটির দিন
বিকাল ৫টা
সিড়ি বেয়ে আমরিন উঠছে। হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। অনেক কিছু কিনেছে।
জুই বাচ্চাদের নিয়ে ছাদ থেকে নামছে। কোলে হুমাইরা, হাতে হাফসা।
-ভাবিই কেমন আছেন।
-এইতো ভাবি আছি।
-ছাদে গিয়েছিলেন?
-হ্যা ভাবি, বাচ্চাদের একটু ঘুরিয়ে আনলাম। বাসায় অস্থির করছিল।শপিং এ গিয়েছিলেন? কি কিনলেন?
-এই তো ভাবি। টুকটাক। আমার একটা থ্রি পিস, সুতির শাড়ি,আয়ানের স্কুলের জুতা, বাসায় পরার গেঞ্জি, আম্মার স্যান্ডেল। আমার এত কিছু কেনার ইচ্ছা ছিল না। আপনার ভাই জোর করল।
-বাহ। মা শা আল্লাহ, বারাকাল্লাহু ফীক। আপনার কপালটা ভালো। আল্লাহ বারাকাহ ঢেলে দিন।
আমরিন হাসছে। বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু হাসছে। মিষ্টি করে।
…………………..
স্বাধীনতা
নূরুন আ’লা নূর
(২২/০৪/১৯)