রক্তাক্ত গোধূলি ২

হাসনীন চৌধুরী

-আজ রাতে কোন ডাক্তার নেই এখানে, আপনারা অন্য কোথাও যান। – প্রায় বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো চপলা পিসি।

রেড ক্রিসেন্ট ম্যাটারনিটি ক্লিনিকের ধাত্রী সে। আজ রাতে কারফিউ জারি হয়েছে, ডাক্তাররা সব চলে গেছে, কারেন্ট নেই। এখানে তেমন জটিল অবস্থার রোগী থাকে না, বিধায় সন্ধ্যায় রোগীদেরকেও যার যার বাড়ীর লোক নিয়ে গেছে। এখন চপলা আর একজন আয়া ছাড়া আর কেউ নেই পুরো ক্লিনিকে। হিন্দু বিধবা চপলা বহু বছর ধরে ধাত্রীর কাজ করে। সবাই তাকে ভালোবেসে চপলা পিসি ডাকে।

এক ঘণ্টা আগেঃ

রাহেলার হাসপাতালে যাবার জন্য আগে থেকেই ব্যাগ গোছানো ছিলো। তড়িঘড়ি করে নিজের ও আদিবের কিছু কাপড়চোপড়, টাকা পয়সা আর পাবলিকা গাড়ির চাবিটি নিয়ে বের হয়ে এলো শফিক। রাহেলা আগে থেকেই বুয়াকে নিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ী দিয়ে নিচে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর বুয়া বলছে, “ধৈর্য ধরেন বিবি সাব সব ঠিক হওয়া যাবো”।

ওদিকে এক হাতে মায়ের হাত ধরে আছে আদিব আর অন্য হাতে তার লাল গাড়িটি। সে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বলছে, “আম্মু আম্মু, আমরা গালিতে কলে বেলাতে যাচ্ছি?” এমনিতেই সে বেশ শান্ত ছেলে, তার ওপর বাবার গাড়িতে করে বেড়াতে যাওয়া তার অন্যতম পছন্দের কাজ। সুতরাং খুব একটা বিরক্ত করছে না সে।

শফিক দ্রুত বুয়াকে আর ছেলেকে গাড়ির পেছনে বসিয়ে, একটান দিয়ে গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে এলো। রাহেলা কোনমতে কাত হয়ে বসে আছে পাশের সিটে। অল্প অল্প গোঙাচ্ছে, দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথার দমক সহ্য করছে। আজ বিকেলেও কি সে ভেবেছিলো, কি কঠিন দুর্যোগ নেমে আসবে তাদের জীবনে কয়েক ঘণ্টার ভেতর!

প্রথমেই তারা গেলো বড় রাস্তার মোড়ের ক্লিনিকে। সেখানে তাদের ঢুকতেই দেয়া হলো না। একজন বুড়ো দারোয়ান ছাড়া পুরো বিল্ডিঙ্গে কেউ নেই, ডাক্তার, নার্স সবাই চলে গেছে। আজ বারটার পর থেকে কারফিউ শুরু হবে। পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করে ফেলেছে, চট্টগ্রাম শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।

বাংলাদেশ বেতার ছাড়লে মনে হচ্ছে, দেশজুড়ে পরম শান্তি বিরাজ করছে। বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দেশে তেমন কিছু হচ্ছে না।

আকাশবাণী কলকাতা ছাড়লে সত্যিকারের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। গমগম ভরাট কণ্ঠে দেব দুলাল চট্টপাধ্যায় বলছেন, “আজ পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম শহরে প্রথমবারের মতো কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাত বারটা থেকে সকাল ছ’টা পর্যন্ত এ কারফিউ চলবে। কুমিল্লার সোনাতলী গ্রামে মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের একটি ক্যাম্প উড়িয়ে দিয়েছে”।

রাত সাড়ে এগারটাঃ

রেডক্রিসেন্ট ম্যটারনিটির সামনে অনুনয় করছে শফিক, “দয়া করে আমার স্ত্রীর অবস্থা দেখুন, একটু সাহায্য করুন। আজ আমাদের কঠিন বিপদ”।

এমন সময় রাহেলা প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলো, “মা, মাগো, আর পারছি না”। মায়ের কান্না দেখে আদিব ও কান্না শুরু করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত চপলা পিসির মন গললো। বললো, দেখুন, আমাদের এখানে কোন ডাক্তার নেই আজ, হারিকেনের আলোয় আমি আর আয়া মিলে যা পারি করবো।

রাত এগারটা চল্লিশঃ

আপনার স্ত্রীকে রেখে আপনারা অন্য কোথাও যান। এখানে আপনাদের আশ্রয় দিতে পারবো না। তাছাড়া সন্তান হতে এখনো দেরি আছে, হয়তো ভোর নাগাদ হয়ে যাবে। আমাদের ফোন নাম্বার নিয়ে যান, সম্ভব হলে সকালে ফোন করে যোগাযোগ করবেন।

শফিক অসহায়ের মতো রাহেলার দিকে তাকালো। হারিকেনের আলোয় তার ঘামে ভেজা মুখ চকচক করছে। কপাল আর নাকের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম আর চোখের কোনে অশ্রু জমে আছে।

“শফি, তুমি আদিবকে নিয়ে নিরাপদ কোন স্থানে চলে যাও। আমার কথা ভেবো না, যা ভাগ্যে আছে তুমি ঠেকাতে পারবে না”।

চপলা পিসি অস্থির হয়ে উঠলো, “আপনি দেরী করছেন কেন, আর পনের মিনিট পর কারফিউ শুরু হবে! কারফিউর সময় রাস্তায় থাকলে, আর বেঁচে ফিরতে পারবেন না। আমরা এখন গেট আটকে দেবো।

এগারটা পঞ্চাশঃ

ঝাপসা চোখে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে আছে শফিক, পেছনে বুয়ার কোলে আদিব ঘুমিয়ে পড়েছে। করাচির ইউনিভার্সিটির দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে বার বার। কি অসাধারণ চৌকস মেয়ে ছিলো রাহেলা, যেমন স্মার্ট তেমন তেজস্বী! সব ছেলেরা তার জন্য পাগল ছিলো, কিন্তু ওর প্রখন ব্যাক্তিত্বের সামনে কারো সাহস হয় নি প্রেম নিবেদন করার।

শফিক সেই তূলনায় ছিল নিতান্তই গোবেচারা বাঙালী ছেলে! ভার্সিটি জীবনে একক্লাসে থেকেও দূর থেকেই ভালোবেসে গেছে রাহেলা কে। শেষে সি এস পি অফিসার হবার পর, রাহেলার বাবার কাছে মেয়ের পাণি প্রার্থী হয়। তিনিও বাঙালী ও অবসরপ্রাপ্ত সি এস পি অফিসার ছিলেন, তাই অতি সহজেই বিয়েটা হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম বন্দরে পোস্টিং হলে তারা চলে আসে, পূর্ব বাংলায়। রাহেলা ঘরকন্যার পাশাপাশি যোগ দেয় বেতারে ইংরেজী খবর পাঠিকা হিসেবে।

এখন এসব কিছুই সুদূর এক সুখ স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে শফিকের। সত্যিই কি জীবন কখনো এতো নিরাপদ ছিলো, জীবনে কি আর কখনো তারা শান্তির ঘুম ঘুমাতে পারবে? কখনো কি স্বাধীন দেশে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবে? না কি আজীবন এই দুঃস্বপ্নের অন্তরালে পালিয়ে বেড়াতে হবে দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে।

নিস্তব্ধ রাস্তায় তীব্র বেগে গাড়ী চালাতে চালাতে মনে হচ্ছে, এক অশুভ সময়ের অশুভ অধ্যায়ে ঢুকে পড়েছে তারা, যার থেকে কোন নিস্তার নেই। মনে হচ্ছে এ আতংকের যেন কোন শেষ নেই।

আর পাঁচ মিনিট পর কারফিউ শুরু হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো শফিক। বাবার ছোট বেলার বন্ধু ছেরু চাচার বাড়িতে গিয়ে উঠবে। চাচা রাউজানের এক গ্রামের জমিদার ও স্থানীয় মুসলিম লীগের সভাপতি। একজন মুসলিম লীগ নেতার বাড়িই এখন তার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা!! শফিককে সব সময়েই উনি অত্যন্ত স্নেহ করেন, এই দু:সময়ে নিশ্চয় ধরিয়ে দেবে না তাকে!

চাচা ছেলেমেয়ে নিয়ে শহরের বিশাল বাগান বাড়িতে থাকেন। এই বাগান বাড়ি এক কালে হিন্দু জমিদারদের ছিল। দেশ ভাগের পর অল্প দামে ছেরু মিয়া কিনে নেয়। এখন যুদ্ধের সময় প্রচূর আত্মীয় তার বাড়িতে জায়গা নিয়েছে।

চাচার বাড়িতে যখন পৌছল, তখন বারটা বেজে দুই মিনিট। বিশাল এ জমিদার বাড়ির প্রধান ফটকে বহুক্ষণ হরণ বাজাবার পর, যে মুহুরতে শফিক গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাবার উপক্রম করছিলো, তখন দারোয়ান এসে দরজা খুলে দিলো।

অন্দর মহলের দরজায় বিশাল দেহী ছেরু মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। “চাচা বাচান আমাকে, বড় বিপদে পড়ে এসেছি”, আকুল কন্ঠে বললো শফিক। ছেরু মিয়ার চেহারায় কোন ভাবান্তর হলো না, আস্তে করে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। আজকাল কোন কিছুতেই কেউ আর অবাক হয় না, সবার অনুভুতিগুলো কেমন যেন মরচে পড়ে ভোঁতা হয়ে গেছে……

*****************************

সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারলো না শফিক। রাহেলা না জানি কেমন অবস্থায় আছে!! আহারে প্রাণপ্রিয় রাহেলা, কেন তোমাকে পূর্বপাকিস্তান নিয়ে এলাম! আমি নিজ হাতে তোমার জীবন টা শেষ করে দিলাম হয়তো…

ক্রমাগত পায়চারি, দীর্ঘশ্বাস, জায়নামজে কান্নাকাটির পর, সুদীর্ঘ রজনী শেষে ভোর হলো। ফজরের সালাত পড়েই চাচার ড্রয়িংরুম এর ফোন দিয়ে ডায়াল করলো ক্লিনিকের নাম্বারে।

একটা রিং পড়তেই চপলা পিসি ফোন ধরলো, যেন ফোনের পাশেই বসে ছিলো।

উত্তেজিত গলায় চপলা বলে চললো, “জলদি আসুন, আপনার স্ত্রীকে নিয়ে যান। দেরি করবেন না দয়া করে। নাহলে অসম্ভব বিপদ হবে….. ওহ… ভোর তিনটায় আপনার একটি মেয়ে হয়েছে।

এই বলে খট করে ফোন রেখে দিলো। এবং আর ফোন ধরলো না। শফিকের মাথায় আকাশ ভেংগে পড়লো। রাহেলার কি কিছু হলো!

রাত জাগা নির্ঘুম চোখে আবার গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। পেছনে ফেলে গেলো ঘুমন্ত আদিবের নিষ্পাপ মুখ খানি।

এক দুর্বিষহ রাত শেষ হলো, আর শুরু হলো যুদ্ধের এক দুর্বিষহ দিন…. (চলবে)

———————
#রৌদ্রময়ী_উপন্যাস