রক্তাক্ত গোধুলীঃ শেষ পর্ব

রাহেলা প্রচণ্ড ইচ্ছা করছিলো, শক্ত করে স্বামীকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকতে। ওকে অফিসের জন্য বিদেয় দিতে এতো কষ্ট হচ্ছে কেন কে জানে! আসলে দেশের অবস্থাটাই এমন, কাছের মানুষগুলোকে এক পলকের জন্যও চোখের আড়াল করতে অস্থির লাগে।

ঠিক তখনি মনি বিনা কারণে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, শফিককে আর জড়িয়ে ধরা হলো না, হাতটাও ধরা হলো না, দৌড়ে গিয়ে মনি কে কোলে নিলো। শফিক চলে যাবার সময় কেনো যেনো বুকটা ধ্বক করে উঠলো। যদিও কিছুক্ষণের মাঝেই ছেলে মেয়েদের পেছনে ছোটাছোটি করতে গিয়ে, এসব কিছুই আর মনে রইলো না ওর।

ঘণ্টাখানেক আগে:

রাহেলা- তুমি আবারো ভেবে দেখো, আসলেই কি অফিস যাবে? তোমার ঐ পিয়নের কথায় বিশ্বাস করে এতো বড় ডিসিশন নিলে! আমার কেন যেন ভালো লাগছে না, কোথায় যেন খটকা লাগছে!

শফিক- তুমি বড় বেশি সন্দেহ বাতিক। সব অফিস আদালত চলছে এখন বরং যারা অফিসে যাচ্ছে না, তাদেরকেই সরকার সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে।

রাহেলা- আবার যদি কোন অন্যায়ের মুখোমুখি হও, তখন কি করবে?

শফিক- আবারো আমি ন্যায়ের পথেই থাকবো, জীবন গেলেও অন্যায় মাথা পেতে নেবো না।

রাহেলা দ্রুত শফিকের মুখ চেপে ধরলো, “এসব কি ধরণের কথা বলো! সাবধানে থেকো, বেশি সাহস দেখাবার দরকার নেই”।

সেদিন সকাল উঠেই শফিক অনেক দিনের উস্কোখুস্কো চেহারাকে ঘষে মেজে, ধোপদুরস্ত কাপড় পড়ে রেডি হয়ে গিয়েছে, আজ ওর মন ভীষণ ফুরফুরে। মনি আর আদিবকে আদর করে বেড়িয়ে পড়লো শফিক।

*********************************

শফিক অফিসে প্রবেশ করে দেখলো বেশ কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে, দারোয়ান আর ক্যাশিয়ার সাহেব বদলে গেছে, গুজব আছে তাদের হানাদারেরা রাস্তায় গুলি করে মেরেছে। ওকে দেখেও অনেকেই চমকে উঠলো, সবাই ভেবেছিলো ওরও একই গতি হয়েছে।

কবির সাহবে ওকে দেখে ছুটে এলেন, “আপনি কেন এলেন, আপনাকে খুঁজতে একবার অফিসে এসেছিলো উনারা! কেউ যদি খবর দেয় আপনি এসেছেন, তখন কি হবে!”

শফিক বললো, “আমার অফিসের কেউ আমার বিরুদ্ধে কেন খবর দেবে, কি আশ্চর্য কথা বললেন মশাই!”

ওদের কথা শেষ হতে পারলো না, তার আগেই বাইরে কয়েকটি জীপ ব্রেক করার শব্দ পাওয়া গেলো, এরপর বুটের ধুপ ধাপ শব্দ। সশব্দে খুলে গেলো সামনের দরজা, রাইফেল কাঁধে নিয়ে কয়েকজন ক্লিন শেভড, ঝকঝকে পোষাক পরা জওয়ান প্রবেশ করলো। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শফিককে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো তারা।

পেছনে রয়ে গেলো আতঙ্কিত চেহারার অফিসের লোকজন। কিন্তু পিয়নের মুখে ক্ষণিকের জন্য ভেসে ওঠা ক্রুর হাসিটি কারো নজরে এলো না। মনে মনে শফিকের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিলো পিয়ন কালামিয়া। বহুদিন আগে তাকে চুরির জন্য ধরেছিলো শফিক, বড় সাহেব সবার সামনে তাকে চড় মেরেছিল সেদিন। আজ সেই দিনের প্রতিশোধ নেয়া হলো!

************************************

এতো দিনের ময়লা ঘর পরিষ্কার করতে বেশ বেগে পেতে হচ্ছে রাহেলার। বই পত্রের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বিয়ের এলবামটি চোখে পড়লো, দু’ জন প্রতিটি ছবিতেই দু’দিকে তাকিয়ে আছে, লজ্জায় শফিক নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, আর বেশিরভাগ ছবিতেই তার নিজের চোখ বন্ধ।

মনে মনে হাসি পেলো রাহেলার। ঠিক তখনি মনে পড়লো, শফিকের অফিসে একটা ফোন দিলে কেমন হয়? খুব কি ব্যাস্ত এখন, ফোন করলে কি বিরক্ত হবে! ফোন করার আগেই ঝন ঝন করে ফোন বেজে উঠলো।

-“হ্যালো, মিসেস শফিক বলছেন? আমি শফিক সাহেবের অফিস থেকে বলছি।”

-“জ্বী বলুন, কি বলবেন।

************************************************

কর্ণফুলী নদীর পাড়ে প্রবল বেগে ঝড়ো হাওয়া বইছে, আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে, যেকোন সময় তুমুল বৃষ্টি আসবে। নদীর পাড়ে দুটো আর্মি জীপ দাঁড়িয়ে আছে। শফিককে হাত বেঁধে দু জন এনে দাঁড় করালো নদীর সামনে। তার এক চোখ ফুলে আছে, সেটি দিয়ে কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। শরীরের জায়গায় জায়গায় বেয়োনেটের খোঁচায় রক্তাক্ত হয়ে আছে।

“শালা, শুয়োর কি বাচ্চে, হামারি সাথ বেইমানি কিয়া, আপনি মুলক কি সাথ বেইমানি কিয়া তুনে, ইতনা বাড়া হিম্মত গাদ্দার কাহি কি! তুঝে ক্যায়া লাগা, তু হামারা জাহাজ আনে নেহি দোগে আওর হাম আনা নেহি আ পায়োগে?”?

লেফট্যেনেন্ট কর্নেল আলতাফ আলি তীব্র ঘৃণা নিয়ে হিস হিস করে কথা বলতে বলতে, শফিক কে ভারী বুট পরিহিত পা দিয়ে সবেগে লাথি দিল। “তুমহারি জ্যয়সা গাদ্দার কা জি’না কি কৈ হাক নেহি হ্যায়”!

লাথি খেয়ে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গেলো শফিক। মাথাটা খুব ভারী লাগছে তার, মনে হচ্ছে যেন এক পৃথিবী সমান ভার মাথার ওপর।

“তুঝে এক মাওকা দেনা চাহতিহু, তুনে জো কিয়া উসকো লিয়ে, মেরি প্যার পাকাড়কে মাফি মাঙ্গনা পাড়েগা! আগার এয়সা কারোগে, তো শায়েদ হাম তুমহে ছোড় দু!”

শফিক এর এক পাশ থেকে আরেকজন হানাদার তার মুখে লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো তাকে, লাথির পর লাথি দিতে থাকলো তারা আর বার বার বলতে লাগলো, “মাফি মাঙ্গ সালা!”

শফিক তার সর্বশক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ালো। তার মনে কেবল রাহেলার মুখ ভেসে উঠছে, তার মায়াময় হাসি আর আদিব ও মনির সরল চাহুনি…বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো… ইশ, আর একটি বার যদি রাহেলার হাতটা ধরতে পারতাম।

মনস্থির করে নিলো ও মনে মনে বললো, “আমাকে মাফ করে দিও প্রিয়তমা, অসম্ভব ভালোবাসি তোমাদের। আল্লাহ্ যেনো জালিমদের থেকে এ দেশ কে রক্ষা করেন।” অতঃপর শেষ শক্তিবিন্দু দিয়ে, আলতাফ আলির মুখে থুতু ছুঁড়ে মারলো।

মুহূর্তেই মুহুর্মুহু গুলির শব্দে চতুর্দিক কেঁপে উঠলো। কর্ণফুলীর উন্মত্তা স্রোত লাল করে দিয়ে অজানা গন্তব্যে ভেসে গেলো, বাংলার এক সোনার সন্তান!

***********************************************

রাহেলা স্থানুর মতো বসে আছে ফোনের পাশে, ফোন সেট থেকে রিসিভার ঝুলছে। তার কোমর পর্যন্ত দীর্ঘ চুল খোলা পড়ে আছে, … রাহেলা বসে আছে তো বসেই আছে। যেন পৃথিবী থমকে গেছে, সময় স্থির হয়ে গেছে…………

ধীরে ধীরে ও শান্তভাবে উঠে দাঁড়ালো, আলমারির ড্রয়ার থেকে শফিকের রিভলবার বের করলো, লোডেড করলো, গাড়ীর চাবি নিলো। বুয়া ও বাচ্চাদের নিয়ে আবার রওনা হলো ছেরু চাচার বাড়ি। চাচির কাছে তাদের জমা রাখলো আর বললো, “আপনি আমার মা এর মতোন, এ শহরে আপনারা ছাড়া আমার আর কেউ নেই, আপনাকে একটাই অনুরোধ, যদি আমার কিছু হয়, বাচ্চাদের দেখে রাখবেন”।

এরপর কাওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাহেলা। চোখ রক্ত জবার মতো লাল হয়ে আছে, কিন্তু কাঁদছে না একটুও। নিজেকে কখনোই অবলা নারী মনে করে না সে, ঘরের কোনে অসহায়ের মতো কাঁদবে না সে।

শফিককে অবশ্যই খুঁজে আনবে! শফিকের যদি কিছু হয়, ও বেঁচে থাকতে একজনকেও ছেড়ে দেবে না…… একজনকেও না!! প্রয়জোনে সে একাই যাবে হানাদারদের ক্যাম্পে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো রহেলা।

***********************************************

কিছুক্ষণ পরের দৃশ্যঃ

হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প খোলা হয়েছে। গেট দিয়ে ঝড়ের গতিতে একটি পাবলিকা গাড়ী প্রবেশ করলো। এরপর ঘটলো অবিশ্বাস্য ঘটনা একজন বাঙালী মহিলা রিভলবার হাতে নিয়ে উরদু ও ইংরেজীতে চিৎকার করতে করতে আলতাফ আলীর রুমে প্রবেশ করলো।

রাহেলা দু হাত দিয়ে শক্ত করে রিভলবার সামনের দিকে ধরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো, “মেরা শফিক কাঁহা হ্যাঁয়? WHERE HAVE YOU KEPT HIM!!!”
.
.
.
.
***********************************************

[ গল্পটি কিন্তু সত্যি ঘটনার অবলম্বনে রচিত, সঙ্গত কারনেই ঘটনার পাত্র পাত্রীর ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে হাতে গোনা কয়েকজন কে পাকিস্তানিরা ক্ষতিপূরন দেবার আশ্বাস দিয়েছিলো, রাহেলা ছিলো তাদের একজন।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, রাহেলা ঐ ক্যাম্প থেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছিলো। যদিও সে তার প্রিয়তম শফিককে ফিরিয়ে আনতে পারে নি।

কিন্তু তাকে কথা দেয়া হয়েছিলো, সন্তানদের আঠারো বছর হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে সরকারি বাসস্থান দেয়া হবে ও ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ দেয়া হবে।

বর্তমানে রাহেলা ও তার সন্তানেরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।]

————– ————–