ডাঙ্গায় তোলা সদ্য মাছের মতো ভিতরে ভিতরে ছটফট করছে শামা। প্রবাসের নতুন এই শহরের একমাত্র পরিচিত আপুর মাধ্যমে আজকের এই গেট-টুগেদারে আসা। কিন্তু এসেই বুঝতে পারলো এই গেট-টুগেদারে শামা-রাহাত একদমই বেমানান। দুই বছরের বিবাহিত শামা-রাহাত দম্পত্তি নতুন শহরে এসেছে দুই মাস হয়।
তেমন কাউকে চিনেনা বিধায় আজকের প্রোগ্রামে আসা যেন একটু চেনা পরিচয় হয়। এসেই বুঝতে পারলো এই গেট-টুগেদারে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হলে আধুনিক প্রবাসী বাঙ্গালী হওয়া বাঞ্ছনীয়। একটা সময় ছিলো যখন শামা-রাহাত এই ধরনের আয়োজন খুব উপভোগ করতো। কিন্তু বিয়ের প্রথম বছর পার হতেই আল্লাহ্র ইচ্ছায় কিছু প্র্যাকটিসিং মানুষের সাহচর্যে একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করেছে তারা।
বিয়ের প্রথম বছরেই শামা-রাহাত উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমায়। বিদেশে এসেই নিজেদের ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী গ্রুপের সাথে মিশতে শুরু করে। এই গ্রুপ যখন তখন পার্টি, লেইট নাইট আড্ডা, আউটিং এত বেশী করে যে নিজেদের জন্য কোন টাইম থাকেনা।
শামা-রাহাতের একসময় বোধোদয় হয় যে এভাবে তো চলা সম্ভব না। নতুন বিয়ে হওয়ার পর এখন দু’জনের দু’জনকে চেনা-জানার সময়। ইউনিভার্সিটির পর পুরা সময় গ্রুপ এক্টিভিটিজে ব্যস্ত থাকলে নিজেদের জন্য কোন সময় থাকেনা। এই ভাবনা থেকেই আসলে ওদের পরিবর্তনের সূচনা। এরপর থেকেই শুরু হয় দু’জনের নতুন করে ধীরে ধীরে ইসলামের রাস্তায় পথচলা।
মেসেজের ভাইব্রেশানের আওয়াজে শামার ধ্যান কাটে। রাহাত মেসেজ দিয়েছে। বের হওয়ার জন্য বলছে। শামা একটু টেনশানেই আছে। বলতে গেলে প্রধানত শামার ইচ্ছার জন্যই এই প্রোগ্রামে আসা। অনেক মানুষের মাঝে বেড়ে উঠা শামার নতুন শহরে অনেক একা লাগে। তাই ভেবেছিলো কিছু চেনা পরিচিত মানুষ হলে ভালো লাগবে। রাহাত নিশ্চয় এমন প্রোগ্রাম দেখে রেগে আছে। এমনিতে রাহাত অনেক ভালো মানুষ। শামার ব্যাপারে অনেক কেয়ারিং। কিন্তু শান্ত চুপচাপ স্বভাবের রাহাত রেগে গিয়ে পুরাই অন্য মানুষে পরিণত হয়।
শামা এমন হাজারো চিন্তা করতে করতে গিয়ে গাড়িতে বসে। বাসায় পৌঁছানো পর্যন্ত দু’জনের মধ্যে কোন কথা হয়না। শামাই যেন নীরবতা ভাঙ্গে,
- ধূর একদম বুঝিনি যে এমন সো-কল্ড সাজগোজের প্রতিযোগিতা, ছবি তুলে বেড়ানো টাইপ প্রোগ্রাম হবে।
- হুম। তাও আলহামদুলিল্লাহ্ যে কয়েকজন মিলে হলেও নামাজ পড়া হয়েছে। ভেবেছিলাম নামাজ না ক্বাযা হয়।
- আমিও একসময় এই টেনশানে ছিলাম।
- যাই হোক এরপর থেকে আমরা কোন গেদারিং এ যাওয়ার আগে চিন্তা ভাবনা করে যাবো।
- রাহাত, আমি না খুব দুঃখিত। আসলে আমি বুঝিনি যে এমন হবে। তাহলে কখনও যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম না। ( রাহাতের উত্তর কি হবে ভেবে ভিতরে ভিতরে ভাবনার জাল বুনে শামা )
- তুমি সরি বলছো কেন? তুমি তো আর আগে থেকে চিনতে না কাউকে। তুমি তো না জেনেই গিয়েছিলে। আর তোমার নিয়্যত ভালো ছিলো। তোমার তো এখানে কোন দোষ নেই। যাই হোক রাত হয়েছে; এখন না ঘুমালে ফজরে উঠতে কষ্ট হয়ে যাবে।
শামার কানে যেন শুধু রাহাতের কথাগুলো বেজে চলেছে। শামা ভেবেছিলো রাহাত হয়তো রাগ করবে কিন্তু কি সুন্দর করে রাহাত রিপ্লাই দিলো। বিয়ের পর প্রথম বছরে মাস্টার্সের পড়া, ঐসব আড্ডাবাজি ঘুরাঘুরির ভিড়েও শামার মাঝে মাঝেই দমবন্ধ লাগতো। মনে হতো ও যেন রাহাতকে ঠিকমতো বুঝেনা। রাহাতও যেন শামাকে বুঝতে চেষ্টা করেনা। খুব অল্পতেই মান-অভিমান, ভুল বুঝাবুঝির সাথে শামার জন্য আতংক ছিলো রাহাতের রাগ।
আল্লাহ্র ইচ্ছায় যতই ওরা দু’জনে ইসলামের পথে চলতে শুরু করেছে ততোই যেন নিজেদের মধ্যের দূরত্ব কমতে শুরু করেছে। দু’জনেই যেন একটু একটু করে নিজেদের বদলাতে শুরু করেছে। আগের রাহাত আর এখন রাহাতের মধ্যে অনেক পার্থক্য। একেই বোধহয় বলে ত্রিভুজ ভালোবাসা।
ত্রিভুজের ভূমির দুই মাথায় যদি স্বামী-স্ত্রী থাকে এবং তাঁরা যদি দু’জনেই উপরের বিন্দুর দিকে চলতে শুরু করে তাহলে তাদের মধ্যের দূরত্ব কিন্তু কমতে শুরু করে। এই উচ্চ বিন্দু হলো আল্লাহ্; আল্লাহ্র জন্য একে অপরকে ভালোবাসতে শুরু করলে এবং নিজেকে আল্লাহ্র জন্য বদলাতে শুরু করলে দু’জনের মধ্যে দূরত্ব ঘুচতে শুরু করে। আর তখনই সম্ভব হয় দাম্পত্য নামক বইয়ের একই পাতায় অবস্থান করা।
আল্লাহ্ যেন সব দম্পত্তিকে এই ত্রিভুজ ভালোবাসার সহজ সমীকরণ বুঝার তৌফিক দান করেন। সব দম্পত্তি একে অপরের জন্য চক্ষু শীতলকারী হতে পারে – এই দোয়া করতে করতেই শামা ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।
ত্রিভুজ ভালোবাসা
-বিনতে হোসেন
(০২/০৫/২০১৯)