ড্রয়িং রুমের কার্পেটের ওপর মেয়ের সাথে অফিস থেকে ফিরে অনেকক্ষণ হুটোপুটি করেছে রোমান। কাতুকুতু দিলে আট মাসের মেয়েটা এত খিলখিলিয়ে আসে যে মনটা ভরে যায়। এই হাসি শোনার জন্য ও বার বার কাতুকুতু দেয়। আর কিচেন থেকে রুমি বারবার সাবধান করতে থাকে যেন বেশি হয়ে না যায়, তাহলে আবার মেয়ের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়ে যাবে। যদিও সে চেঁচিয়ে হুঁশিয়ার করতে থাকে কিন্তু তার খুশিমাখা কণ্ঠেই বোঝা যায় সন্ধ্যায় বাবা-মেয়ের এই খেলাধুলার সময়টা সেও খুব উপভোগ করে।
অনেকক্ষণ মেয়েকে সময় দিয়ে এবার মেয়ের হাতে তার প্রিয় খেলনাটা ধরিয়ে দিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসল রোমান। অফিসের একটা জরুরী মেইল করা লাগবে। কিচেন থেকে রুমির রান্না করার টুকটাক শব্দ আসছে। পায়ের কাছে বসে মেয়েটা এখন আপন মনে খেলে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় ফেরার পরই রুমি ওকে হালকা চা-নাশতা দিয়েছিল। ভরা পেটে, প্রফুল্ল মনে রোমান কাজ করতে বসল। মেইলে ঢোকার আগে ফেসবুকে অফিসের গ্রুপে আপডেট দেখতে ঢুকল। হোমপেইজে প্রথমেই সাদিকের পোস্ট চোখে পড়ল। যথারীতি মেয়েদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা একটা ট্রল।
সাদিকের স্বভাব আর পাল্টালো না, মনে মনে ভাবল রোমান। গত মাসেই সাদিকের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তবে তাই বলে একারণে ও এসব পোস্ট দিচ্ছে তা না। সাদিক ওর স্কুল জীবনের বন্ধু। ওকে রোমান ভালোই চেনে। হাই স্কুল থেকেই একটার পর একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়তে সে ছিল ওস্তাদ। কিছুদিন মেশার পরই আর কোন মেয়েকে ওর ভালো লাগত না। বন্ধুদের কাছে এসে আগের গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করত। আবার কিছুদিন পর সহজেই আরেক মেয়েকে দেখে ওর ভালো লেগে যেত। বয়স বাড়ার সাথে সাথেও ওর এই স্বভাবে কোন পরিবর্তন আসেনি। ডজন ডজন মেয়ের সাথে ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত যদিও একজনকে সে বিয়ে করেছিল, কিন্তু সেই একজনের মাঝে আর নিজের মনকে সে আটকাতে পারেনি।
ফলাফল, বিয়ের কিছুদিনের মাঝেই সে স্ত্রীর নানা খুঁত ধরতে লাগল, নির্দিষ্ট কোন কারণ ছাড়াই বা মনগড়া কারণে স্ত্রীকে তার অসহ্য লাগতে শুরু করল। ওর অস্থির স্বভাবে ওর বউও হাঁপিয়ে উঠেছিল। একসময় তুমুল ঝগড়াঝাঁটি এবং অবশেষে বিবাহ বিচ্ছেদ। রোমানের মনে হয়, একজন সঙ্গী ছাড়া সাদিকের চলেও না আবার সঙ্গীর থেকে সে কী চায় সেটা সে নিজেও জানে না! বহু মেয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে দিতে ওর চোখই পচে গেছে।
রোমানের আরেক বন্ধু আছে ফয়সাল। গতকালও কথা হয়েছে তার সাথে। ফয়সাল পাত্রী খুঁজছে বিগত ছয় বছর ধরে। রুমির সাথে রোমানের বিয়ের পর সে রুমিকেও বলেছিল তার জন্য পাত্রী দেখতে। রুমি একটু খোঁজখবর করে বুঝেছে যে ফয়সাল সুন্দরী পাত্রী চায় এবং এযাবৎকালের মাঝে তার কোন পাত্রীকেই বিয়ে করার মতো সুন্দরী মনে হয়নি। রুমিও আর আগ্রহ দেখায়নি স্বামীর এহেন বন্ধুর জন্য পাত্রী খুঁজতে। রোমানের আবারও মনে হয়, বহু মেয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে ওরও অন্তর মরে গেছে।
রোমান এবার নিজের কথা ভাবল। প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি ওকে হলের এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে দ্বীনের পথে নিয়ে এসেছিলেন। নাহলে হয়ত ওর জীবনটাও এই বয়সেও ওর বন্ধুদের মতো এলোমেলো থাকত। বিপরীত লিঙ্গের দিকে দ্বিতীয়বার ইচ্ছাকৃতভাবে তাকানো যে গুনাহ এটা জানার পর থেকে সে সচেতনভাবে চেষ্টা করে এসেছে নিজের দৃষ্টি নামিয়ে চলতে। এই জন্য ক্লাসের মেয়েরা আড়ালে হাসত, কিছু ম্যাডামরা বিরক্ত হতো কিন্তু ওর মেধা আর ব্যক্তিত্বের কারণে সবাই যে ওকে সম্মান করত এটাও সে টের পেত। ওর ভালো চাকরি, বিয়ে কোনকিছুই এইজন্য আটকে থাকেনি।
রুমির সাথে বিয়ের কথা যখন চলছিল তখন ওর পরিবার থেকে সম্বন্ধ পছন্দ করলেও জানিয়েছিল যে মেয়ে অতটা সুন্দরী না। রুমি আসলেই প্রচলিত অর্থে সুন্দরী না। কিন্তু মাঝারী গড়নের, উজ্জল শ্যাম বর্ণা, মার্জিত রুমিকে রোমানের একবারেই ভালো লেগেছিল। ওর পরিবারের এসব কথাবার্তা বিয়ের পর রুমিরও কানে এসেছিল। কিছুটা যে সে মন খারাপ করেনি তা না, কিন্তু রোমান বলেছিল সারা পৃথিবীর কাছে তুমি যেমনই হও, আমার কাছে তুমি সুন্দরী। আর এটাই আসল।
দৃষ্টির হেফাযত করার সুফল রোমান আজ নিজের জীবনে দেখতে পাচ্ছে। তার ঘরে মমতাময়ী স্ত্রী আছে, ফুটফুটে সন্তান আছে। তার শেকড় আছে। প্রশান্ত মনে রোমান আবার কাজে মন দিল।
চোখ
– বিনতে খাজা
(২৪/০২/২০১৯)