“আপনি বসুন , আমি দেখছি কি ব্যাপার। “
দোকানের লোকটা রোবুটুশ কে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আমার রোবুটুশ। যেটা আমায় খালামনি দিয়েছিল। কেমন খেলতো , আওয়াজ করতো , ওয়ান টু থ্রি আর কালার্স ও বলতে পারতো। কি যে হলো হটাৎ করে।
ছোট বেবি ওর হাতটা ধরে মুখে দিতো। কত বুঝিয়ে বলি , বেবি খেয়ো না , আমার রোবুটুশ কে খেয়ো না। তবু সে খাবেই। যা পাবে তাই হাতে নিয়ে প্রথমে মুখে ভরবে। তারপর চুষতে লাগবে , আর গড়িয়ে গড়িয়ে লালা পড়বে , ইয়াক!
মা বলে মুখে হাত দিলে নাকি পেটে পীড়ে হয়। আমাকে কত বকে, কিন্তু বেবিকে কিচ্ছুটি বলে না।
বাবা বললো , ‘চলো ওকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাই। আমরা যেমন অসুখ করলে ডাক্তার এর কাছে যাই , খেলনার অসুখ করলেও খেলনার দোকানে নিয়ে দেখিয়ে আনা যায়। হয়তো ওরা ধরতে পারবে তোমার রোবুটুশ এর কি অসুখ করলো?’
তাই আমরা দোকানে এসেছি। কিন্তু আংকেল বেরই যে হচ্ছেনা পেছনের রুম থেকে।
বাবা বড় ভাল। আমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। আমার সাথে কথা বলে। অন্যদের মতো হু হা করে কাটিয়ে দেয়না। মা পেঁয়াজ কাটতে কাটতে আমার সাথে কথা বলে , কিন্তু আমি জানি মা কিছু না শুনেই জবাব দিচ্ছে। ‘রোবুটুশ কে ন্যাপি পরিয়েছি মা , বেবির মতো, কেমন লাগছে?’
“দারুন !”
মা কাজ করতে করতেই বললো কিন্তু ও দেখেই নি।
আসলে আমি তো ন্যাপি পরাইনি ,টিস্যু দিয়ে ন্যাপি বানিয়ে পরিয়েছি
সেটা মা খেয়ালই করলো না , এমনি এমনি বললো দারুন।
বললো ‘যাও সোনা রান্নাঘরে না , ঐরুমে যেয়ে খেলো , রান্নাঘর ডেঞ্জারাস।’
আমি চলে যাই।
মা খালামনি কে বলে , ‘দারুন জিনিস এনে দিলি রে , ওই নিয়েই পড়ে থাকে সারাক্ষন। এই খাওয়াচ্ছে , ন্যাপি পরাচ্ছে , রাতে পাশে নিয়ে শোবে ,গোসল দিবে, কত কাহিনী। ভালই হয়েছে ব্যস্ত থাকায়। আমি একটু শান্তি পাই। দুটোর জ্বালায় মাঝে মাঝে মনে হয় চলে যাই কোনোদিক।’
আমার ভয় করে। মা চলে গেলে আমি তো থাকতে পারবো না। আর বেবির কি হবে?
তাই আমি ওই ঘরে গিয়ে খেলি , মা কে জ্বালাই না।
“বাবা , আমি একটু ওদিকে যাই ?”
হাত দিয়ে খেলনা সারি করে রাখা তাকগুলো দেখালো খোকা।
‘যাও , তবে বেশি দূরে যেও না কেমন? চোখের সামনেই থাকো। নইলে হারিয়ে যাবে।’ হেসে বললো বাবা।
ছেলেকে দেখে মায়াই লাগে । সবকিছু কত সহজ করে ভাবে । কলুষতা এখনও স্পর্শ করেনি ওর নিষ্পাপ কচি মন। জীবনের জটিল পাঠগুলো তাই সহজ করে এর মধ্যেই দিয়ে দিতে চায় খোকার বাবা ।
হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে খোকা। মাত্রই না গেলো , কি হলো আবার ?
“বাবা দেখে যাও , কি আশ্চর্য কান্ড!”
খোকার চোখে বিস্ময়।
হাত ধরে টানতে টানতে বাবাকে নিয়ে যায় খোকা।
“আমার রোবুটুশ ! এত্তোগুলো ? ওই ওখানে রাখা আছে।
কোথা থেকে এলো ওগুলো বাবা? ওরা জানলো কিভাবে আমার একটা রোবুটুশ আছে ? আজই যে প্রথম নিয়ে এলাম? আর বানিয়ে ফেললো একদম একইরকম ?”
খোকার প্রশ্নবানে জর্জরিত বাবা। দেখলো খালামনির দেয়া রোবট খেলনাটাই মোড়কবন্দি হয়ে সারি সারি করে সাজানো আছে তাকে।
‘খোকা, শোনো, বসো এখানে। ‘
পুত্রের কৌতূহলী চোখের তারায় চোখ রাখলো পিতা।
‘এগুলো খেলনা। তোমার রোবুটুশ এর মতোই অনেক খেলনা বানায় এই দোকানের আংকেলরা। তোমার খালামনির এঁনাদের কাছ থেকেই কিনে নিয়ে গেছে তোমার জন্য।আরও অনেক কাস্টমার এসে কিনে নিয়ে যায় তোমার খালামনির মতো। ‘
‘তার মানে আমার রোবুটুশ এর মতো আরও অনেক রোবুটুশ আছে আরও অনেক জনের কাছে ?’
‘হুম।’
খোকা কিছু বলে না। কি যেন ভাবে চুপ করে।
“এই যে নিন। কোনো সমস্যাই নাই তোমার রোবটের বাবু ! খালি একটা জিনিস লাগবে। আমি নিয়ে আসছি।”
দোকানির ডাক শুনে কাউন্টারে ফিরে এসেছে ওরা।
হাসি হাসি মুখ করে দোকানি আবার কি যেন আনতে বেরিয়ে গেলো।
রোবুটুশ কে নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো খোকার মুখ। আবার সহসাই গম্ভীর হয়ে গেলো। সেটা খেয়াল করলো বাবা।
‘কি ব্যাপার সোনা ?’
বাবার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে খোকা বললো , ‘বাবা, মা যে ছোট বেবিকে আনতে হাসপাতাল গিয়েছিলো আর বললো ওখানে আরও অনেক বেবি আছে? তাহলে আমাদের বেবির মতো সেইম সেইম বেবি , আরও অনেকের আছে ?’
মৃদু হাসলো বাবা। বাচ্চাদের কত অবুঝ মনে করি আমরা ! অপরিপক্ক। অথচ এই ওরাই কত কিছু খেয়াল করে! খেয়াল করে মিলাতে চেষ্টা করে। আর মিলিয়ে উপসংহার টানে আমাদের অজান্তেই। আমরা কি সেগুলো খেয়াল করি ?
‘নাহ সোনা। তোমার ছোট বেবি ব্রাদার তোমার একটাই। ইউনিক। ওর মতো দ্বিতীয়টি আর কেউ নেই। ওকে আল্লাহ শুধু তোমার ভাই করে তোমার কাছেই পাঠিয়েছেন। ‘
শুনে চোখমুখে কি রকম একটা গর্ব যেন ঝিলিক দিয়ে উঠে খোকার। ভাইয়ের একছত্র মালিকানার কাছে অন্য যে কোনো মালিকানা যেন ম্লান হয়ে যায় ।
‘এই নাও , ব্যাটারি। ও রোবটের পেটে ভরে দিলে একদম ঠিক চলবে ফিরবে আগের মতো। খুশি ?’ দোকানি ফিরে এসেছে।
‘ব্যাটারি কি বাবা?’
‘ব্যাটারি হলো তোমার রোবুটুশের বড়ি। চলো ওকে বড়ি খাইয়ে তোমার শেলফে রেখে দেই , দুদিন রেস্ট নিলে দেখবে আবার আগের মতো চলছে ফিরছে।’
খুশি মনে বাড়ি ফিরে আসে খোকা আর বাবা।
দুদিন হলো খোকা বেজায় দরদ করছে ছোট্টকে। সারাক্ষন আলতো আদর , চুমো লেগেই আছে। খামচা খামচি নাই। আগের মতো খেলনা ধরলে বকেনা , কান মলে দেয় না। ও যে খোকার একটাই , ইউনিক পিস্ বেবি ব্রাদার !
‘কি জাদু করে আনলে গো দোকান থেকে? খোকা যে আর সেই খোকাটি নেই এক্কেবারে।’ দু ছেলেকে বুকে চেপে হাসতে হাসতে বাবাকে শুধায় খোকার মা।
বাবা কিছু বলে না। হাসে কেবল ।
খোকার বাবা বেশিরভাগ সময়ই কিছু বলেনা। কিন্তু খোকা বুঝে , বাবা অনেক ভাবে। ভেবে ভেবে তারপর অল্প একটু বলে। ও শুনতেই খোকার কত ভালো লাগে!
খোকার বাবা আসলেই ভাবছিলো।
একদিন খোকাদের খেলনার পৃথিবী ছাড়িয়ে আসল পৃথিবী হবে। খোকারা বৈষয়িক হবে। বাস্তবতা, অংশীদারিত্ব , অধিকার বুঝতে শিখবে। তখন যেন সম্পত্তির আগে সম্পর্কগুলোকে মূল্যায়ন করতে পারে ওর খোকারা ।
নীরবে দোআ করে বাবা , রাব্বানা হাবলানা মিন আঝওয়াজিনা ওয়া জুররিয়াতিনা কুররাতা আ’ইউনিওওয়াজআ ‘লনা লিল মুত্তাকিনা ইমামা।
…………….
খোকার খেলনা
– উম্ম ঈসা
(০৯/০৪/২০১৯)