আমার নাম এমিল। আমার আরেকটা বড় ভারী নামও অবশ্য আছে। কিন্তু ও নামে আমায় শুধু আমার স্কুলের টিচাররা ডাকে।
মার একটা বিদঘুটে অসুখ করেছিল। আমি তখন মার পেটে। যে ডাক্তার মাকে সাহায্য করেছিল ওঁর নাম ছিল এমিল। মা আমায় সে গপ্পো বলেছে। ওঁরা নাকি তখন দূরের দেশে একটা ক্যাসল টাইপ বাড়িতে থাকতো।
কিন্তু এখন আমি অনেক ব্যস্ত কারণ আমাদের একটা প্রদর্শনী হবে হলরুমে। সবচে সুন্দর ছবিগুলো স্থান পাবে ওখানে। আমার টিচাররা বলে আমি নাকি অনেক সুন্দর ছবি আঁকি , তবে এবারের ছবিটা হবে একেবারে অন্যরকম। কারণ ওই যে অদ্ভুতুড়ে আলখাল্লা পরা আইল্যান্ডার লোকটা, সে আমাকে এক শিশি অদ্ভুত রং দিলো। এতে নাকি ছবির মধ্যে আশ্চর্য ঘটনা ঘটবে।
আচ্ছা আমাকে এখন আঁকতে হবে , ততক্ষনে তোমরা মার গপ্পোটা শুনে আসো।
…………………………
বসার ঘরে ঢুকে হালকা অবাক হলেন ড: হাসান ।
“আরে জামান সাহেব যে!”
সালাম আর করমর্দন সেরে সোফায় বসলেন দুজন।
“কি ব্যাপার বলুন তো , সক্কাল সক্কাল?”
এতক্ষনে যেন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু অপ্রস্তুত বোধ করলো জামান।
“স্যরি , এই সকালবেলায় ডিস্টার্ব করতে চাইনি। আসলে একটু ডেসপারেট সিচুয়েশনে পড়েছি। আপনার কথাই মনে হলো প্রথমে।” কিছুটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললো সে।
“না না আমার আজ বাসা থেকেই কাজ করার প্ল্যান ছিল। নাস্তা নিশ্চয় করে আসা হয়নি , একটু কফি করি?” পরিবেশটা সহজ করার জন্য চট করে বললেন ড: হাসান।
“আপনি ব্যস্ত হবেন না , আমি বেশি সময় নেবো না।” আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকালো সে। দ্রুত কথায় যাওয়া দরকার ওর, বেশি ভনিতা করতে চায়না।
ড.হাসান প্যারাসাইকোলজির প্রফেসর। এ বিষয় উনার কমিউনিটিতে কেউ তো পড়েই না , সব ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার। তার উপর উনার রিসার্চ টপিকটা আবার আরও উদ্ভট। এখানকার জার্নালে অবশ্য বেশ কটা কেস স্টাডি বেরিয়েছে, ভালোই নামডাক তাই এ ফিল্ডে। এখানে আছেন প্রায় ১৫ বছরের মতো। দু সপ্তাহ আগে গ্রোসারি করতে করতে সামনের আইলে দেখলেন দেশি লোক। এ দেশে এমনিতেই দেশি মানুষ কম , এ স্টেটের দিকটায় তো প্রায় চোখে পড়েনা বললেই চলে। তাই এগিয়ে গিয়েছিলেন আলাপ করার জন্য।
জামানের ডিপার্টমেন্টও বাক্সের বাইরের ডিপার্টমেন্ট। আর্কিওলজি। রিসেন্টলি যে ডিসকভারিটা হল ওটার কাজেই ওর এখানে আসা। ড. হাসানের নাম খবরের কাগজে দেখেছিলো ও, পরিচিত হয়ে ভালোই লাগছিলো জামানের। ভদ্রলোক বেশ অমায়িক।
দুজনেই সদালাপী ,দুজনের বেশ জমে গিয়েছিলো। বাসায় আসার আমন্ত্রণ সেদিনই জানিয়ে আসলেও উনি যে এভাবে ভোরবেলা ফোন ছাড়া উদয় হবেন ভাবেননি ড. হাসান।
“বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?
” ইয়ে …আমার স্ত্রী …মানে ওর কারণেই আপনার কাছে আসা। ও একটা অদ্ভুত ঘটনা ফেস করছে রিসেন্টলি। এতে ওর মনে এতই প্রভাব পড়েছে যে প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে , দিন দিন কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে।”
” আই সি! ঘটনাটা কি একটু খুলে বলা যায় কি?”
“কিছুদিন ধরে প্রায়ই মাঝরাতে দেখি ও বিছানায় নাই , উত্তর পূর্বের একটা ঘর আছে ওখানে যেয়ে বসে থাকে, একটা পেইন্টিং আছে ওয়ালে , ওটার দিকে তাকিয়ে। ভালো করে জিগেশ করায় শেষ পর্যন্ত বললো পেইন্টিংটায় নাকি মানুষ আসা যাওয়া করে।আমি হেসে উড়িয়ে দেবো ভেবে আমায় বলেনি।”
“প্রেতাত্মা ট্রেতাত্মা ধরণের বিষয়?
“ঠিক তা না, সে দিনের বেলায় ছবিটি যেমন দেখে রাতের বেলায় নাকি সেরকম না। একটা পার্থক্য আছে। এর বেশি ভেঙে সে আমাকে আর বলেনি। আমার মনে হয়েছে বিষয়টা বেশি খোঁড়াখুঁড়ি না করতে যাওয়াই ভালো।”
“আপনার থাকার এরেঞ্জমেন্ট সরকার যেখানে করেছে , দ্যাটস বীজার! ওরকম পুরানো একটা ম্যানশনে ভয় তো লাগারই কথা।”
” ঐদিকটায় পুরানো নির্মাণ অনেক আছে বৈকি , তবে আমাদের থাকার অংশটা পুরো রেনোভেট করা।আদ্যিকালের মূর্তি আর পেইন্টিং গুলো সরিয়ে ফেললে বোঝার উপায় নেই এটা এতো পুরোনো বাড়ি।আপনি আসুন একদিন, দেখলেই বুঝবেন।
তাছাড়া ও নিজেও এন্ট্রপোলজির ছাত্রী , পুরোনো বাড়িঘর দেখলে বরং একসাইটেডই হয় ..কিন্তু ওকে ঠিক মেলাতে পারছিনা আগের সাথে ..” কিছুটা আড়ষ্ট স্বরে বললো জামান।
“তা সে পেইন্টিং আপনি দেখেছেন ?”
“কাজের এতো চাপ ছিল কদিন , ভেবেছিলাম উইকেন্ডে ভালো করে সময় নিয়ে দেখবো ব্যাপারখানা কি ,কিন্তু কাল রাতের পর সেই সুযোগ তো আর রইলো না। “
“কেন? কি হলো কাল রাতে?” চাপা গলায় প্রশ্ন করলেনা ড. হাসান।
“আমি নিজেই এখনো এত কনফিউজড , ওর মতো এতো হাসিখুশি একটা মেয়ের এই কদিনে কি হয়ে গেলো যে এমন একটা কাজ করলো!” জামানের গলায় স্পষ্ট অসস্তি।
“সাড়ে তিনটার দিকে ফজরের জন্য ঘুম ভেঙে যায়। উৎকট একটা পোড়া গন্ধ ধরে বাড়ির পেছনের দিকটায় যেয়ে দেখি একটা ফায়ার পিট্ ছিল ওটায় আগুন ধরিয়েছে ও, পট পট শব্দ করে পুড়ছে মোটা ক্যানভাসের একখানা অয়েল পেইন্টিং। মিলির আয়ত চোখ দুটোতে কেমন উদ্ভ্রান্ত নিষ্ঠুরতা। ওর নাম মিলি বাই দ্য ওয়ে।”
” সেই পেইন্টিংটাই যেটা দিনে আর রাতে এক থাকেনা বলছিলেন?
“জানিনা, ও শুধু ক্লান্ত চোখে বললো ও নাকি আর ওটাকে সহ্য করতে পারছিলনা।
ওই মুহূর্তে আমি আর কিছু জিজ্ঞেশ করিনি। ওকে বিছনায় এনে পানি খেতে দিলাম। ওযু করে নামাজটা পড়ে শুলো , আর ঘুমিয়ে গেলো। বোঝাই যাচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি সে। আমি মর্নিং ওয়াকের নাম করে আপনার এখানে এসেছি। নাও দিস ইজ গোয়িং ঠু ফার।” কপালে হাত চেপে দম নেয়ার জন্য থামলো জামান।
ড. হাসান একদৃষ্টি তে তাকিয়ে আছেন। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ।
“আমার রিসার্চের সাবজেক্ট অবশ্য “সেন্সড প্রেজেন্স ” নিয়ে, তবে উনি আসলেও কারো উপস্থিতি টের পেতেন কিনা এ ব্যাপারটা তো ধোঁয়াশে। আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিছু মনে করবেন না, আপনি আসলে কি ধরণের হেল্প চাইছেন আমার থেকে একটু খোলাসা করতেন যদি। “
“আমার ধারণা ওর একাকীত্বটাই মানসিক ব্যাধির জ্বালানি হচ্ছে। আমার কাজ তো জানেনই , সারাদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে হয় এমন অবস্থা।
প্রফেশনাল কারো সাথে যদি ও মন খুলে কথা বলতে পারতো , আমার সাথে বলবেনা সে আমি জানি।আপনার গবেষণা তো এ বিষয়েই , তাই মনে হলো কোনো ধরণের মেন্টাল কাউন্সেলিং এর উপায় যদি বাতলে দিতে পারতেন।”
“আচ্ছা ,উনি রিসেন্টলি কি কোনো ধরণের স্ট্রেস এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন? বা শারীরিক কোনো অসুস্থতা?” কেসটা বোঝার চেষ্টা করছেন ড: হাসান।
“সেরকম কিছু তো খেয়ালে আসছেনা। “
“আপনি একটু বসুন , আমার আগের কেস স্টাডির এক রিসার্চ এসিস্টেন্ট ছিল। ও সাবজেক্ট এর সাথে কথা বলে বলে কৌশলে ডাটা কালেক্ট করতে পারতো। ও ফ্রি আছে কিনা দেখি। যদি আসলেই ক্লিনিক্যাল কোনো হেল্প লাগে সেটা না হয় পরে ব্যবস্থা করা যাবে’খন। “
“জ্বি।” পরামর্শটা মনে ধরল জামানের। “উনি মিলিকে কিছুটা সঙ্গ দিতে পারলে তো ভালই হয়। “
“ওঁর নাম ‘এমিল’।
আপনার স্ত্রী কে একটু টাচ দিয়ে রেখেন , যে এমিল যেতে পারে।”
সেদিনের মতো কথা শেষ করে চলে আসলো জামান। এসে দেখলো মিলি তখনও ঘুমাচ্ছে। প্রকান্ড জানালার ফিনফিনে পাতলা পর্দা ভেদ করে সকালের নরম রোদ এসে পড়ছে ওর মুখে। জামানের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। স্ত্রী কে বড় ভালোবাসে সে।
………………………….
সারি সারি পাইন আর দেবদারু গাছের মাঝ দিয়ে গাড়িটাকে আসতে দেখল মিলি। দোতালার জানালা থেকে বেশ অনেকদুর পর্যন্ত রাস্তা দেখা যায়। ওর মনের ভাব থমথমে। পোর্চের সামনে এসে দাঁড়াতেই মিলি ভাবলো এই বুঝি নামলো নাক উঁচু, ককেশিয়ান মনের বদ্যি। মনকে ভাল রাখার জন্য কত আধুনিক আর কত স্যোশাল হওয়া দরকার সেই নিয়ে যিনি খাঁটি একসেন্টে লেকচার দিবেন।
কিন্তু কালো ভক্সওয়াগন থেকে যিনি নামলেন তাঁর বেশভূষায় মিলি খানিকটা হকচকিয়ে নিচে নেমে আসলো।
মুখের ভাবটা সৌজন্য দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে ‘হ্যালো’ বলবে না কি বলবে এই করতে করতে “সালাম আলেখুম সিস্টার” বলে এমিলই প্রথম হাত বাড়ালো।
এমিল যে রিভারটেড মুসলিম তখনই প্রথম জানলো মিলি।
মনে মনে ভেবে রেখেছিল কিছুতেই সাইকোলজিস্টের কাছে নিজের মনকে মেলে ধরবেনা ও। ওকে একটু বুঝতে চেষ্টা না করে ডাক্তার ডাকতে গিয়েছে বলে জামানের প্রতি ক্ষোভ জমেছিলো ওর মনে। এনাকে দেখে সে ক্ষোভ একেবারে উবে গেল।এমিলের চাহনিতে একটা এম্পাথি আছে, কিছু বলা লাগলো না, হাসিমুখ আর একটা আন্তরিক হাগই যেন মিলিকে অনেক হালকা করে দিল। ওর মনে হলো এর কাছে সবই বলা যায়। কোথা থেকে কি শুরু করবে সব ঠিকও করে নিলো মনে মনে। কিন্তু ভদ্রমহিলা মিলির রহস্যের ধারে কাছেও গেলেন না। সারাটা দিন শুধু নিজের গল্পই বললেন।
কিভাবে উনার হরর নভেলের নেশা ছিল সেই থেকে সাইকোলজিতে পড়া। তারপর একসময় ভুডুইজম , স্যাটানিজম এইসব পড়তে পড়তে মন্ত্রের বই থেকে বেদ , গীতা , বাইবেল করে একদিন কুরআন হাতে তুলে খুবই আশ্চর্য হলেন। ব্ল্যাক ম্যাজিক যে রিয়েল সে কথাও আছে আবার ড্রামা না করে কি সুন্দর সায়েন্টিফিক সল্যুশনও আছে। আসলেই তো! সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ,যার কর্তৃত্ব সবকিছুর উপর , তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়!
“ইউ নো মিলি ..” বলে নিজের কথা আরও বলতে লাগলো এমিল।
আমি মুসলিম হবার পর অনেক গুলা কেসস্টাডি হ্যান্ডেল করার সময় সূরা ফালাক , নাস , আয়াতুল কুরসী এগুলা পড়ে পড়ে সাবজেক্টের কাছে যেতাম , আর তাতে আশ্চর্য ফল হতে লাগলো। সে কথা অবশ্য আমি কাউকে ভেঙে বলিনি তবে ফল যে হচ্ছে তা আমি নিজেই বুঝতাম আর বুঝতেন ড. হাসানও। লাস্ট কেসগুলাতে তো এতো প্রম্প্ট রিকভারি দেখে জার্নাল পাড়ায় মাতামাতি পড়ে গেলো।
কিন্তু দুঃখ কি জানো ? সবরকম কুসংস্কার নিয়ে রিসার্চ আছে, মানুষ আবোল তাবোল কে প্যারানরমাল নাম দিয়ে শক্ত গ্রাউন্ডও দিয়েছে , কাজ হচ্ছে এগুলাকে বেইজ করেও , খালি ১৪০০ বছর আগের কুরআন নাকি ভিত্তিহীন আর বানোয়াট , অন্ধ বিশ্বাস !
আমার খুব শখ মনের উপর এই সূরা গুলির ইফেক্ট নিয়ে একাডেমিক একটা রিসার্চ করা। তো প্লাসিবো বলে চালিয়ে দিবে ! দুঃখ ঝরে পড়লো ওর কণ্ঠ থেকে।
“তাছাড়া ফান্ড তো পাবনা। ফান্ড ছাড়া এক্সপেরিমেন্ট, রিসার্চ কেমন করে চলবে বলো? দুঃখ লাগে মুসলিম ইউনিভার্সিটি গুলোই ইন্টারেস্ট দেখাবে না , প্যারাসাইকোলোজি শুনলে হেসে উড়িয়ে দিবে। “
মিলি তন্ময় হয়ে শুনছিলো। সারাজীবন যেসব দিক নিয়ে ওকে কেউ চিন্তার খোরাক দেয়নি , এই বিদেশিনী যেন কয়েক মুহূর্তের আলাপেই নতুন কিছু রিয়ালাইজেশন দিয়ে গেলো।
কিন্তু ..তাও কিন্তু থেকেই যায় …রাত হলেই দিনের এই রৌদ্রোজ্জ্বল সুন্দর পরিবেশ যেন অসত্য হয়ে যায় !
পর্দার ওপাশে সে কারো উপস্থিতি টের পায় , সাথে টুংটাং সাইকেলের আওয়াজ , ওর অসহ্য লাগতে তাকে। ও ঘুমাতে পারেনা। ছবিটা পুড়িয়ে ফেলেও শান্তি নাই।
কালই এমিল কে সব খুলে বলবে ঠিক করে ও।
পরদিন আবার কালো ভক্সওয়াগন থেকে নামে কালোয় মোড়া সদাহাস্যময়ী এমিল।
“আমি ছবি আর মূর্তি গুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখছিলাম এসেই ।” মনের পাঁপড়ি গুলো মেলতে শুরু করেছে মিলির । এমিল মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
এতো রিয়েল সব মূর্তি আর পেইন্টিং! সব ঘরে ঘরে! সিঁড়ির নিচের উত্তর পুবের ওই ঘরটায় খালি একটা সিনারি , তো ওটা আর ঢাকিনি। ঠিক করলাম ও ঘরেই নামাজটা পড়বো।
জোহরের সময় দেখি সে পেইন্টিং এ একটা মেয়েও আছে । মুখ ঘুরানো পিছনের অবয়বটাই ঝাপসা করে আঁকা। গাছগাছালি ঢাকা বুনো একটা বাগান , খয়েরি কাঠের পিকনিক টেবিল , সে টেবিলের পাশে একটা সাইকেল দাঁড় করানো, সাইকেলটায় হেলান দিয়ে আছে মেয়েটা।
ভাবলাম কাল রাতে মুভিং এর টায়ার্ডনেসের কারণে ওটা বুঝি চোখ এড়িয়ে গেছে আমার ।
একেবারে মানুষের বা প্রাণীর মুখ না বলে আর ঢাকলাম না , কিন্তু এশার সময় নামাজ পড়তে ঢুকে ছবির দিকে চোখ যেতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। ছবিটাতে মেয়েটা নাই! এই একটু আগেও মাগরিবের আগে ছিল!
এরপর প্রতিদিন ঘটতে লাগলো এই ব্যাপার। আমি খুব কাছে যেয়ে, পেইন্টিংটা নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলাম। কয়েকবার ওয়াল থেকে খোলার চেষ্টাও করেছি ।
একদিন মনে হলো ভিডিও করে দেখি। কপাল খারাপ হওয়ায় ফোন অন করে আসার পরে দেখি বাতাসে না কিসে ফোনটা পড়ে গেসে। সে ভিডিও তে কেবল ঘরের সাদা ছাদ উঠে রয়েছে। এরপর ভাবলাম আমি নিজেই বসে থাকবো। রাতের বেলা মেয়েটার ছবিটা থাকেনা দিনের আলো ফুটতেই ওটা কোত্থেকে উদয় হয় আমি দেখেই ছাড়বো।
কিন্তু একটা দিন ও আর জেগে থাকতে পারিনা। ঘুম লেগে আসে. জামান এসে কয়েকদিন আমাকে ওই ঘরেই ঘুমিয়ে পড়তে দেখেছে মেঝেতে। বুঝছিলাম সে খুব টেনশনে পড়ে গেছে যে আমার কি হলো! কিন্ত আমাকে যে নেশায় পেয়ে গেছে।
যেদিন জামান ড. হাসানের কাছে গেল ওই রাতের কথা। মগ ভর্তি কফি খেয়েছি। আজ আমি এর শেষ দেখেই ছাড়বো।
একেবারে পুবের আকাশ একটু ফর্সা হয়ে আসছে। বিশাল জানালা দিয়ে আলোর প্রথম রেখাটা ছবির উপর এসে পড়ে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম পর্দার ওপারে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।
ছবির দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে এখনো কেউ নেই।
পর্দার ছায়াটা আস্তে আস্তে গাঢ় হতে লাগলো , মানে যার আবির্ভাব হয়েছে তিনি এগিয়ে আসছেন। আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হলো। তাহলে কি এই জানালা ভেদ করে সে মেয়ে ছবিতে এসে ঢুকবে আর আমি সেটার সাক্ষী হবো ? কি যে এক অশরীরী জেদ চেপে বসলো। যেভাবেই হোক এ পেইন্টিং সরাতে হবে। আমার মাথায় ভুত চেপেছে যেন। ওকে ঢুকতে দেওয়া যাবেনা এভাবে। এভাবে পেইন্টিং এ ঢোকা যায় না , রং হয়ে তুলিতে করে উঠে ওই পেইন্টিং এই বন্দি থাকতে হয় । জগতের সব নিয়ম ভঙ্গ করে সে এটা করতে পারে না। একটানে নামালাম ও ছবি। এতো শক্তি যে কোথা থেকে এলো আমার বাহুতে আল্লাহই মালুম !
পিট্ এ আগুন ধরালাম।
চোখ ডলতে ডলতে দেখি জামান এসে উদয় হয়েছে , আমার চেহারা দেখে আশ্চর্য এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন ওর মুখে !
কিন্তু কিছু জিজ্ঞেশ করল না , এতো চাপা .. এতো চাপা এই লোকটা যে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সে আসলে মানুষ না। একটা রোবট।
মাথাটা দপ দপ করছিলো , নামাজটা পড়েই ঘুম দিলাম আর ও বেরিয়ে গেলো।
এমিল এক গ্লাস পানি নিয়ে এসেছে।
“এখানেই কি শেষ ?”
“হুঁ।” ঢক ঢক করে পানিটা শেষ করলো মিলি।
এমিলের কেন যেন মনে হলো এখানেই শেষ না ,আরো কিছু আছে।
সেদিন রাতে জানালার কাছে আবার পায়ের আওয়াজ পেলো মিলি। স্পষ্ট বুঝলো কেউ এসে নিচে থেমেছে। কিন্ত এর পরে শুরু হলো হাঁচোড় পাঁচোড় এর শব্দ! কিছু কি দেয়াল বেয়ে উঠে আসার চেষ্টা করছে ? আমি কারো ঘর পুড়িয়েছি , তাই আমার উপর প্রতিশোধ নিবে?
পেটের ভেতর খালি হয়ে গেলো মিলির , জানালা দিয়ে নিচে তাকানোর প্রবল বাসনাটাকে জলাঞ্জলি দিতে হলো , কারণ বুঝলো ও মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে!
প্রকান্ড হাসপাতাল বিলিডিং এর সামনে অপেক্ষা করছে জামান। মিলি এখানেই ভর্তি আছে। ডাক্তাররা ওকে দেখছে। ড. হাসান আর এমিল কে খবর দেয়া হয়েছে উনারা আসছেন।
সাদা গাউন পরে, পাতলা ঠোঁটের চশমা পড়া ডাক্তার সাহেবা বের হয়ে আসলেন। “দ্য টেস্ট রেসাল্টজ আর হিয়ার মি. জ্যামান , কংগ্রাচুলেশন্স!”
মিলির প্রেগনেন্সির খবর জামানকেই প্রথম দিলো ওরা , আর বললো সারপ্রাইজটা তোমার ওয়াইফ কে তুমিই দাও।
এমন একটা অপ্রত্যাশিত নিউজে জামানের একই সাথে আশ্চর্য আর আনন্দ লাগছিলো। কেবিনে ঢুকে এক অদ্ভুত প্রত্যয়ে মিলির হাতটা শক্ত করে ধরলো জামান। চাকরি চুলোয় যাক , এখান থেকে বের হতে হবে তাকে ।
ড. হাসান আর এমিল অবশ্য খুশিই হলো ওর এ সিদ্ধান্তে , এমিল শুধু একবার এসেছিলো লাস্ট দেখা করতে, কিছুক্ষণের মধ্যেই এয়ারপোর্টের জন্য রওনা দিতো ওরা কিন্তু এমিলকে দেওয়ার মত সময় মিলির ছিলো !
“আমি জানিনা। আমার অনুভূতিগুলো কি ভুল ছিল? আমার ইন্দ্রিয় কি আমাকে সব ভুল ইনফরমেশন দিচ্ছেলো?এ কি শুধুই হরমোনের উঠানামা? নাকি বাস্তবতাও ছিল কিছু?” ব্যাকুল হয়ে যেন একটা উত্তর খুঁজছিলো মিলি।
এমিল শুধু একটা কথাই বলেছিলো ওকে , “দেখো এ পৃথিবী বড় রহয়স্যময় ঠিক আছে। কিন্তু সব রহস্যময়তার মালিক কিন্তু একজনই।
এই যে মন ভেঙে আমাদের কান্না আসে , ঘূর্ণিবায়ু হয় , রংধনু উঠে , ভূমিকম্প হয় সবই কি রহস্যময় না ? কিছু কার্যকারণ আমাদের চোখের সামনে থাকে , কিছু থাকে চোখের বাইরে।তিনি যদি চান তোমাকে কার্যকারণ দেখিয়েও দিতে পারেন , এ সব যে তাঁরই এখতিয়ারে।
ভালো থেকো মিলি, লিখো আমাকে খারাপ লাগলে। ” কালো ভক্সওয়াগনে ওঠার আগে বললো এমিল।
নীল চোখের এই পরদেশী বোনের কথাগুলোকে বুকে গেঁথে নিয়ে এরপর মিলি চলে আসে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর অন্যপাশে।
মিলির আর এমিল কে লেখা হয়নি।
অচেনা দেশের অচেনা একটা শহরে কিছু কিম্ভুত ঘটনা আস্তে আস্তে মিলির স্মৃতিতে অতীত হয়ে যায়। এমিল নামটা থেকে যায় শুধু তার মেয়ের নামে।
………………….
তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছাচ্ছে এমিল , একটু পরে ক্লাসরুম থেকে ওদের সবাই কে হলরুমে নিয়ে যাওয়া হবে।
গার্ডিয়ানরা ইতিমধ্যেই এসে জমা হয়েছে। মাও নিশ্চই এসে গিয়েছে। মা যখন ছবিটা দেখবে কেমন মজা হবে ? ভেবেই ফিক করে হেসে দেয় ও আপনমনে।
“এই যে , এটা আমার ছবি” মার হাত ধরে নিজের ছবির সামনে এনে দাঁড় করে এমিল।
গাছগাছালি ঢাকা বুনো একটা বাগান , খয়েরি কাঠের পিকনিক টেবিল , সে টেবিলের পাশে একটা সাইকেল দাঁড় করানো , সাইকেলটায় হেলান দিয়ে আছে মেয়েটা।
“মানুষের ছবি তো আঁকা নিষেধ তাই ঝাপসা করে এঁকেছি মা , তাও একটা মজার ব্যাপার হবে জানো ? যেই সূর্য ডুববে মেয়েটা চলে যাবে !”
এ তথ্যটা তো এমিলের মুখ থেকে জানার কোনো প্রয়োজন ছিল না ওর। এ তথ্য যে সে নিজের জীবন দিয়ে জানে!
এমিলের চোখে একটা দুষ্টু হাসি।
“তুমি কি বলছো ? এসব দুষ্টুমি ভালো লাগেনা আমার এমিল। ঠিক করে বল। ”
ঠান্ডা গলায় মা বললেন। মা এতো রাগ করছেন কেন, গলায় কান্না এসে যাচ্ছে এমিলের। ও ভাবছিলো মা খুবই সারপ্রাইজড হবার ভঙ্গি করে বলবে “তাই !”
“আমার টিচারের নিউ আ্যসিসট্যান্ট, ফিসফিস করে বললো এমিল ,ওই যে দেখছোনা কোনায় দাড়িয়ে আছে আইল্যান্ডার বুড়োটা, ওই দিলো এই রং !
আইল্যান্ডের বুনো জঙ্গলে স্পেশাল মাড দিয়ে ওর ঠাকুমা নাকি বানিয়েছে এটা।
ওই রংটায় কেবল সানলাইট পড়লেই দেখা যায় , সান চলে গেলে আর মনেই হয়না ওখানে কিছু ছিল। তাই রাত হলে মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। অল্প একটুখানি রং শিশিতে দিলো। ও দিয়ে শুধু মেয়েটার ছায়া এঁকেছি। কি ইন্টারেষ্টিং না , মা?”
“এরকম কোনো রং হয়না এমিল, তুমি জানো। ” কি শক্ত গলায় বললো মা। এরকম কোনো রং কেউ দেখেছে কখনো?”
মায়ের ফোনে টুং করে একটা মেসেজ আসলো , “আজ বারবিকিউ এর দাওয়াত দিয়েছো মানুষকে ভুলে গেছো? এমিলকে পাঠাও বাইরে আমি ওকে নিয়ে বাজার করে একবারে বাড়ি ফিরবো , তুমি বাসায় যেয়ে আয়োজন শুরু করো। ” এমিলের বাবার মেসেজ।
“এমিল তুমি বাইরে যাও , বাবা ওয়েট করছে, বাবার সাথে পছন্দের সসেজ আর ড্রামস্টিক কিনবে ।আমি আর্ট টিচারের সাথে কথা বলে আসছি।”
“ওকে মা। বলে ঝুটি দোলাতে দোলাতে ব্যাগ নিয়ে বের হলো এমিল “
রঙের প্রসঙ্গ ওখানেই চাপা পড়লো।
আলখাল্লা পড়া বুড়ো আইল্যান্ডারকে কোথাও দেখা গেলো না , ভীড় ঠেলে এমিলের আর্ট টিচারের দিকে এগিয়ে গেলো ওর মা। বুড়ো আর ওই অদ্ভুত রং এর কথা জিজ্ঞেস করার জন্য। সে কি শুধু এমিলকেই ও রং দিয়েছে না আরো কেউ পেয়েছে? সবাই টিচারকে ছেকে ধরেছে। সন্তানের প্রথম প্রদর্শনীর ছবি সবারই চাই, ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে গর্বে বুক ফুলে উঠবে ওদের।
আর্ট টিচার ঘুরতেই , কিসে যেন ওর মুখ আটকে নিলো। কিছু রহস্যের ব্যবচ্ছেদ না করাই কি ভালো না ?
“ইয়েস? মে আই হেল্প ইউ ? “
উমম ..ইয়া ..ক্যান আই টেইক মাই ডটার্স পেইন্টিং হোম ম্যাম ?
“অফ কোর্স , শী ইজ এ জিনিয়াস মাই গশ ! ঠু গুড উইথ কালার্স। এন্ড ভেরি ইমাজিনেটিভ আই মাস্ট সে। হিয়ার ইউ গো !”
পেইন্টিং এর কাগজটা মুড়ে ব্যাগে নিয়ে বাসায় ফিরলো এমিলের মা।
রাতে সবাই এসে বাহবা দিতে লাগলো।
“খুব সুন্দর করে সাজিয়েছো মিলি! ” বললো ওর জা।
ছোট ছোট এতো সুন্দর লাইটিং ব্যাক ইয়ার্ডে। দুই আউটডোর গ্রিলে বারবিকিইউ এর পেট মোচড় দেয়া সুবাস।
জামানের হটাৎ মনে হলো মিলির মুখটা অন্যরকম লাগছে।
“তুমি ঠিক আছো তো?”
মিলি কিছু বললো না। স্মিত হেসে চাদরটা আরো শক্ত করে পেঁচিয়ে নিলো কেবল। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে এবার। কড়িকাঠ দিয়ে ফায়ারপিটের জ্বালানি আরেকটু চাগিয়ে দিলো সে। পট পট করে উঠলো আগুনের কমলা ফুলকি। ওখানে চেলাকাঠ , খড় , শুকনোপাতা ছাড়া জ্বালানি হিসেবে আছে আরও একটি কাগজ!
এমিলের অদ্ভুত রং
– উম্ম ঈসা
(২৮/০২/২০১৯)