এপিঠ-ওপিঠ

১.
দশটা বাজতে আড়মোড়া ভাঙ্গলো প্রিন্স। হাত বাড়িয়ে মিউজিক অন করলো সে। মিউজিকের তালে তালে আস্তে আস্তে পা ঝাকাতে লাগলো প্রিন্স। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। মিউজিক ছাড়া দিনটা শুরু করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।ওয়েস্টার্ন মিউজিক তার পছন্দের শীর্ষে। মিনিট দশেক পরে চাঁন মিয়া ঢুকলো ঘরে। তাকে বলে দেয়া আছে সে ঠিক সকাল ১০:১৫ মিনিটে ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায় প্রিন্স কে।

চাঁন মিয়া কে দেখে হাসিমুখে উঠে বসলো প্রিন্স।

বসো চান। একা একা কফি খাওয়াটা বেশ বিরক্তিকর। আজ আমার সাথে কফি খাও।

জ্বি না স্যার। মাথা নাড়ে চান মিয়া।

কফি না খেলে চা খাও?

আমি রোজা আছি স্যার। আজকে ৮ম রোজা চলছে।

ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে তুমি যাও। হাত নাড়ে প্রিন্স।

দুমাস হলো ক্রাশ ডায়েট ফলো করছে প্রিন্স। সেই সাথে জীম। সে বিশ্বাস করে “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।” তাই নিজের শরীরের দিকে কড়া নজর রাখে প্রিন্স। দেশের সবচেয়ে বড় ডায়েটিশিয়ানের তত্ত্বাবধানে আছে সে। এখন কফি সেরে সোজা জীমে চলে যাবে সে। নিয়োগকৃত ট্রেইনার অপেক্ষা করছে প্রিন্সের জন্য।

°°°°°
রাত জেগে পড়ে, সেহরী করে, নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো আদনান।।তার বাবা চাঁন মিয়া কাজে গেছে। বিশাল বড়লোকের কেয়ারটেকার তার বাবা। সামনে ওর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা তখনই দিতে পারবে যখন কিনা ফর্ম ফিলাপ করতে পারবে।টাকাটা এখনো জোগাড় হয়নি। তার বাবা বলেছে ঠিক ব্যবস্থা করবে।

রোজা তাতে কি? আল্লাহর রহম আছে না? রোজা রেখে সারা দিন পড়াশোনা করছে আদনান। রাতে তারাবীহ। তারপর রাতজেগে পড়াশোনা। রেজাল্ট বরাবরই ভালো আদনানের। পড়াশোনা শেষ করে আল্লাহ চাইলে ভালো চাকরি জুগিয়ে বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাবেই আদনান। দিন রাত এই স্বপ্নেই বিভোর থাকে আদনান। মায়ের ভালো চিকিৎসার জন্য বড় ডাক্তার দেখাবে, ভালো একটা বাসা ভাড়া নেবে আরো কত কি!!

২.

শফিক সাহেব কদিন যাবৎ খুব টেনশানে দিন কাটাচ্ছেন। মেয়েটা কিচ্ছু খায় না। পৃথিবীর কোন খাবারেই তার কোন রুচি নেই। চিকেন, বিফ,জ্যাম, জেলী, বার্গার, চায়নিজ, থাই, দেশী কোন কিছুই তার পছন্দ না। সব খাবার দেখলেই নাক সিঁটকায় লাবণ্য।

ক’দিন হল তার কোমরে ব্যথা। লাবণ্য কে দেখে ডাক্তার বলেছেন, কোন রোগ নেই। খাবার খেতে হবে ঠিকমতো। কিন্তু এই অরুচির কোন সুরাহা করতে পারেন নি শফিক সাহেব। মেয়ের কোন খাবারেই কোন রুচি নেই। সকালে লাবণ্যর মা ডিম সেদ্ধ করে তাকে খেতে দিয়ে কি কাজে কিচেনে গিয়েছে অমনি লাবণ্য টুক করে ডিমটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। ডিম দেখলেই গা গুলায় তার!

°°°°°
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেই ওপর থেকে ঠিক পায়ের ওপরে এসে একটা ডিম পড়লো। থমকে দাঁড়ালো শারমিন। সেদ্ধ ডিম না? হাত দিয়ে তুলে নিলো সে ডিমটা। ওপর থেকে পড়াতে ফেটে গেছে আর ময়লাও লেগেছে। ওপর দিকে তাকালো শারমিন। আলিশান বাড়ি। কেউ খাবে না বলে হয়তো ফেলে দিয়েছে।

আহারে জীবন!! তার দু বছরের ছেলেটা অপুষ্টিতে ভুগছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বলে দিয়েছে রোজ ডিম আর পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে। কিন্তু কোথায় পাবে সে রোজ এসব? ঘরে অসুস্থ স্বামি আর অপুষ্ট বাচ্চা রেখেই ঝিয়ের কাজ করে শারমিন। দ্রুত শাড়ির আঁচলে ডিমটাকে বেঁধে নিলো শারমিন। ঘরে ফিরে ধুয়ে ছেলেটাকে খেতে দেবে বলে।

৩.

ল্যান্ড ফোনটা বেজেই চলেছে। কিন্তু তুলছেন না মোটে গাজী রহমান। অগ্নিদৃষ্টিতে বোরহানের দিকে তাকালেন তিনি। কটমট করে বললেন-

তোমাকে বললাম ফোনটা ডিসকানেক্ট করে রাখতে।
বোরহান মিনমিন করে কি বললো বোঝা গেলো না ঠিক।

গতকাল এইচ. এস. সির রেজাল্ট বেরিয়েছে। পুলিশের ডি. আই.জি মোঃ গাজী রহমান পড়েছেন মহা ফাঁপড়ে। না পারছেন বাইরে বেরোতে না পারছেন ঘরে টিকতে। তার একমাত্র ছেলে রিফাত যে এভাবে তাকে সম্মান সমেত ডোবাবে তা কি তিনি ভেবেছিলেন? এখন ছেলেটাকে গছাবেন কোথায়? না হয় বিদেশ পাঠালেন কিন্তু ভর্তির আগে মার্কশীট টা তো দেখতে চাইবে তারা। তিন সাবজেক্টে ফেল করে তার সুপুত্র টি এখন কোথায় অবস্থান করছেন তাও তিনি জানেন না!

….
মনোয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন আঙিনায়। গা কাঁপছে তার। বিপুল সজোরে জড়িয়ে ধরেছে তাকে।
আব্বা, কিছু বলো। চুপ করে আছো কেন? ও মা তুমি কোথায়? হলো নামাজ? চিৎকার করে মাকে ডাকে বিপুল।

সালাম ফিরিয়ে প্রায় ছুটে বেরোলেন শান্তা বেগম। ছেলের রেজাল্ট বেরিয়েছে! ভালো খবরই হবে। ছেলের পরিশ্রম আর তার দোআ তো আল্লাহ ফিরিয়ে দেবেন না?

গোল্ডেন পেয়েছি মা। মা কে জড়িয়ে ধরলো এবার বিপুল।

আলহামদুলিল্লাহ। কেঁদে ফেললেন শান্তা বেগম।

এবার মেডিকেলে চান্স পাবোই। তুমি দেখো।

হ্যা বাবা পাবি ইন শা আল্লাহ। দোআ করি।

নীরবে দরজা খুলে বাইরে আসলেন মনোয়ার। হাত দিয়ে চোখের কোণাটা মুছলেন তিনি। একনিষ্ঠ ভাবে খেটেছে ছেলেটা। আজ তার ফল পেলো। বড় শখ বিপুলের সে ডাক্তার হবে। ভালো কোন কোচিং এ ছেলেটাকে ভর্তি করাতে চান তিনি। কিন্তু….. তার জন্য তো টাকা দরকার। টাকাটা জোগাড় করতে হবে তাকে। যেভাবেই হোক। তিনি বেঁচে থাকতে একমাত্র ছেলের স্বপ্ন বৃথা যেতে দেবেন না।

সারাদিন রিক্সা চালান মনোয়ার সাহেব। ঠিক করলেন এখন থেকে রাতেও চালাবেন। খাটুনী হোক খানিকটা। কোথাও থেকে ধার করে টাকাটা জোগাড় করবেন বলে ঠিক করলেন মনোয়ার।

৪.

মুন্নী এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাহের কে।

তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো তা আমি বুঝতেই পারিনি।

তাই? হাসিমুখে বললো তাহের।

হু। মাথা ঝাঁকালো মুন্নী।

আজ মুন্নীকে বেশ ঝলমলে দেখাচ্ছে। সকালেই তাহের তার কথামতো তার বুড়ো মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে। ঝামেলা গেছে। আর সারাদিন প্যান প্যানানি শুনতে হবে না। এবার শুধু সে আর তাহের।

°°°°°
গতকাল বিয়ে করেছে শুভ। নতুন বউ নাজনীন একটু লাজুক স্বভাবের। বেশী কথা বলেনা, চুপচাপ থাকে।

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় শুভর। পাশে তাকিয়ে দেখে বউ নেই। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে শুভ। এত রাতে যাবে কোথায়? টয়লেটে যায় নি তো? ভেজানো দরজা খুলে বাইরে এলো শুভ। দাওয়ায় হারিকেনের আলো দেখতে পেয়ে সেদিকে এগোলো শুভ। নাজনীনের কান্না শুনতে পেলো এবার ও। তার মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নাজনীন বলছে-

মাকে হারাইছি কবে। ভাবছিলাম বিয়ের পরে নতুন করে মা পাবো। কিন্তু আমার কপালে মা নাই। তাই মায়ের দোআ নিয়ে সংসার শুরু করতে পারলাম না।

চোখ থেকে অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়লো শুভর।

৫.
জসীমের হাত ধরে গতকাল বাড়ি থেকে পালিয়েছে তুলি। ঘর ছাড়ার আগে তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা তার ফুটফুটে তিন বছরের মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে তুলি। স্বামির জমানো সব টাকা নিয়ে প্রেমিক জসীমের সাথে অজানা গন্তব্যে পা বাড়িয়েছে সে।

°°°°°
আয়েশার বিয়ে হয়েছে আজ বারো বছর। তার স্বামি রায়হান কলেজে শিক্ষকতা করান। দেশ -বিদেশের অসংখ্য ডাক্তার দেখিয়ে আজ এক আল্লাহর রহমতের আশায় বুক বেঁধে আছে এই দম্পতি। বারোটি বসন্ত পেরিয়ে গেলেও সন্তানের আগমণ বার্তা শোনাতে পারে নি আয়েশা তার প্রিয় মানুষটিকে।

টিভিতে খবর দেখছিলো আয়েশা। হঠাৎ দেখে পরকীয়ার বলি তিন বছরের ফুটফুটে শিশু কন্যা আসমা। পাজর ভাঙ্গা ব্যথা টা কাউকে দেখাতে পারেনা আয়েশা। শুধু স্রোতের মত কান্না উপচে পড়ে তার দু চোখ বেয়ে।

এপিঠ-ওপিঠ
জাকিয়া সিদ্দীকি

জুলাই ১৪, ২০১৯ইং