উপর থেকে মিলিদের গাড়িটা একটা ছোট্ট লাল গুবরে পোকার মত দেখাচ্ছে। গুবরে পোকাটা বিশাল ঝুলন্ত ব্রিজ পার হচ্ছে।
একটানা ল্যাপটপ এ কাজ করতে করতে মিলির ঘাড় লেগে এসেছে।
মিলি গ্লাসটা আরেকটু নামিয়ে দিতে বললো। রাস্তার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই জামানের হাত চলে গেলো অটো বাটনে। মোমের মত নিঃশব্দে গেলো কাঁচটা। সমুদ্রের নোনা ঘ্রানওয়ালা বাতাস এসে ঢুকতে লাগলো ভিতরে ।
চারবছরের মধ্যে চারবারের মতো জায়গাবদল হলো ওদের।
মেলিসা জার্ভিসকে ফাইলটা আজকের মধ্যেই সেন্ড করতে হবে ওর। সব লিখে ‘সেন্ড’ চাপার আগেই
টুং করে বেজে উঠলো মেসেঞ্জার। জিমেইলের উইন্ডো বন্ধ হয়ে মেসেঞ্জারের বৃত্তে বুড়ো আঙুলের চাপ পড়ে গেলো। ভেসে উঠলো সীমার মেসেজ।
“যাওয়ার আগে একটু এদিক হয়ে গেলিনা? আচার দিতাম! জলপাই , বরই দুইরকমই বানিয়ে রেখেছিলাম তোর পছন্দের”
বিরক্ত মুখে ড্র্যাগ করে নোটিফিকেশনটা উধাও করে দিলো ও স্ক্রিন থেকে।
এক পালা চাচা ফুপুদের জামানা গত হওয়ার পর এখন কেউ আর আচার , বড়ি করে পাঠায় না। আচার , বড়ি খাবার মত সময়ও এখন ওর নেই। কি যে স্ট্রেসে যাচ্ছে দিনগুলি। কে বুঝবে? সীমা বুঝবে? আছে তো ওই সংসার , আচার বানানো , আর এর তার খবর নিয়ে।
৭ নম্বর চাচার ৫ নম্বর কন্যা। ওর কৈশোরকালের বেস্টি।
কাজিনরা কবেই যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত , জীবন নিয়ে ব্যস্ত। এক সীমাই থেকে গেলো দেশে। সময় অসময়ে ফোন করে সবার খবর নেওয়া ,দেওয়া। দেশে গেলে দুই একটা জিনিস বেঁধে দেওয়ার জন্য হুড়াহুড়ি করা। বড় চাচির সাইনাসের অপারেশন হলো, তো মেজো ফুপিরা বাড়ি বিক্রি করে মুভ করছে। দুনিয়ার গপ্পো জুড়ে দেয়া মেয়েটার একটা বদ স্বভাব।
মিলিদের জীবন এখনও অগোছাল। ভালো করে সেটলই হতে পারলোনা ওরা কোথাও। জামানের বেস্ট ফ্রেন্ড এক সাথে জব শুরু করেও এখন টপ ম্যানেজমেন্ট লেভেলে। নিউ সিটিতে বাড়ির বুকিং ও দিয়ে ফেলেছে।
মিলিদের আনসার্টেইনিটি শেষই হচ্ছেনা। মাঝপথে জামানের পিএইচডি কুইট করতে হলো, উপায় ছিল না।
ব্যস্ততা যাচ্ছে মিলির খুব। নতুন জবটার অফার , কন্ট্রাক্ট এর খুঁটিনাটি পড়া। ওদিকে আগের সুপারভাইজারকে মেইল দেওয়া।
এর মাঝে বাচ্চাদের স্কুল থেকে লিভ নেওয়া সংক্রান্ত জটিলতা।
রোটারি ক্লাব এর তিনটা ফান্ড রেইজিং ডিনার এর ফ্লায়ার বানাতে হবে। ওখানে ভলান্টিয়ার এর কাজ করে ও। মাথাটা ভন ভন করছে ওর।
আই সিম্পলি ডোন্ট হ্যাভ টাইম ফর দিস , মনে মনে সীমা কে বলে ও।
আই হ্যাভ বিগার থিংস টু ওয়ারি এবাউট দ্যান জলপাই , বড়োই। সরি সীমা।
কার কি হইলো , কে কিসে ভুগতেসে। . এতো সোশালাইজেশনের সময় নাই ওর। সবাই যার যার আখের গুছিয়ে নিচ্ছে।
দেশে গেলেই চারিদিক থেকে খালি দাওয়াত আর দাওয়াত। এতো দাওয়াত খেতে গেলে ওদের ও ফিরতি খাওয়াতে হবে তো , নাকি? এতো সময় কার আছে বাপু?
কিছুদিনের মাঝে কতগুলি কাগজ ছুটাতে হবে!
পার্মানেন্ট অফারটা যেন হাতের মুঠোয় চাঁদ পেয়েছে ও। সবগুলি ক্রাইটেরিয়া ভীষণভাবে কি সুন্দর মিলে যায় ওর নীড এর সাথে। এ সুযোগ কোনোমতেই ছুটতে দেয়া যায় না। চোখ কান বন্ধ করে সে এগুলোর জোগাড় যন্ত্র করে এসেছে এতদিন।
ব্রিজ এর শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ওদের গাড়ি। কতকিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে এতো লম্বা ব্রিজটা নিমেষে পার করে এলো ওরা টেরই পায়নি।
দূর থেকে ধবধবে সাদা লাইট হাউজ দেখা যাচ্ছে। ওটার পাশেই জলছাপের মতো ওদের রুপালি বাড়ির ছাদ।
ফাইনালি হোম। স্বস্তির নিঃশেষ ফেললো।
কত কাজ যে জমে আছে!
পরের সপ্তাহে দু দুটো পোস্ট আসলো মিলির নামে ।
একটা চিঠি আর একটা কার্ডবোর্ডের চারকোনা বাক্স ডেলিভারি হলো ওদের রুপালি ছাদের বাড়ির এড্ড্রেসে।
“বিকজ অফ অল দ্য নেসেসারি পেপারওয়ার্কস ডিলে, উই আর সরি টু লেট্ ইউ নো দ্যাট দ্য কন্ট্রাক্ট হ্যাজ বিন ক্যান্সেলড। থ্যাংক ইউ ফর ইয়োর টাইম। উই উইশ ইউ লাক ইন ইয়োর নেক্সট এন্ডেভার “
চিঠিটা পড়ে মিলি কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না। এতদিনের এরেঞ্জমেন্ট , এতো সময় , এনার্জি ইনভেস্টমেন্ট , এতো শ্রম …সব এক নিমেষেই মিছে হয়ে গেলো।
দম বন্ধ হয়ে আসছিলো ওর , পুবের দরজাটা খুলে দিতেই চোখ পড়লো পোর্চ এ পড়ে আছে কার্ডবোর্ডের বাক্সটা।
মাইন্ড ডাইভার্ট করতে ওই খুলতে বসে গেলো ও। বেরিয়ে এলো দুটো বয়াম। জলপাই আর বরই এর আচার। সাথে ছোট্ট একটা চিঠি , “রেহানার কাছ থেকে তোর এড্ড্রেস নিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। আশা করি যাবে ঠিকঠাকমতো। ভালো থাকিস।” – সীমা।
কাঁপা হাতে চোখে পানি নিয়ে বয়াম খুলতেই নাকে এসে লাগলো সরিষার তেল , পাঁচফোড়নের মিশেল গন্ধ – ও চলে গেলো ১৫ ? না ২০ বছর আগে যেন?
ছোট চাচীর রোদে দেয়া আচার গপ গপ করে গিলছে দুটো বেণী বাধা দুই বোন. খাঁ খাঁ রৌদ্রের কি যে একটা ঘ্রান ! কলতলার পাশ দিয়ে হাঁস গুলো প্যাক প্যাক করে আসছে , পিছে দাদি এইমাত্র গোসল সেরে এসেছেন …’দ্যাখসোনি মাইয়া দুইডার কারবার ..ও মাইজ্জা বউউ …’ আম্মুর দৌড়াতে দৌড়াতে হকচকিয়ে আসা ..আর আমাদের সে কি দৌড়! …
ছোট চাচীর কোলন ক্যান্সার ধরা পড়েছিল , বেশিদিন বাঁচলেন না। সবার ছোট হয়েও সবার আগেই চলে গেলেন। স্টেটস এ বসে শুনেছিলো ও , কিন্তু তখন ও ও ফার্স্ট প্রেগনেন্সি নিয়ে হাসপাতাল দৌড়াচ্ছে , পরে কথা হয়নি আর চাচা বা চাচি কারো সাথেই …দাদিও চলে গেছে , আম্মুও চলে গেছে , যে যার সময় মতো।
আচারের বয়ামে নাক ডুবিয়ে মিলির মনে হচ্ছিলো ও কি যেন এক অমূল্য রতন ফেলে এসেছে , জানে কোথায় , তবুও আর কোনোদিন ফিরতে পারবেনা ওটা নিতে কখনও ..
ঠিক জিনিসের , ঠিক সময়ে মূল্য সে দিতে পারেনি … দ্য চয়েসেস শী মেইড , ডিড নট চুজ হার এট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে !
কন্ট্রাক্ট ক্যানসেলের লেটারটা একপাশে সরিয়ে রেখে চোখ মুছে ফোনটা হাতে নিলো ও ..
” প্রিয় সীমা , অনেক অনেক ধন্যবাদ……। তোরা কেমন আছিস? সরি আসার সময় দেখা করে আসতে পারলাম না। “
অনেক আগে পড়া একটা হাদিস মনে পড়েছে আজকে তার
“যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি হোক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে(১)”
দৃশ্যটা সুন্দর। রোদের মাঝে দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছে মিলি , পাশে আচারের বয়াম খোলা। মাঝে সাত সমুদ্র তেরো নদী থাকলেও মিলি আর সীমা যেন ফিরে গেছে আবার সেই সময়ে যে সময় তার বহু আগেই ফেলে এসেছে। সূর্য হেলে বেলা পড়ে আসছে , মেসেঞ্জারের টুং টাং শব্দ থামছে না। যেন পুরোনো একটা সেতু আবার মেরামত হচ্ছে।
(১)বুখারী/মুসলীম
আচার
উম্মে ঈসা
অগাস্ট ২৬, ২০১৯ইং