হাতের ছোট্ট সাদা প্লেনটাকে রুমের বায়ু কেটে দ্রুত গতিতে আকাশের দিকে মেলে ধরে উড়তে দিলো মিনি। বায়ু কেটে কেটে প্লেনটা দ্রুত ঢেউ তুলে উড়ছে মিনির হাতের মুঠোয় থেকেই। আর মিনির মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে প্লেনটার ইঞ্জিনের শব্দ।
বসার ঘরে ফ্লোরে বসেই খেলছে মিনি। বয়সটা সবার জানা মতে পাঁচ হলেও মিনির মতে ৫১ বছর বয়স চলছে এখন মিনির। মিনির মায়ের চলছে ৯৯ বছর বয়স, বাবার ১০০। দাদুমনির ৪০। সাদা বিল্লুর ৭৩। কিন্তু দাদুমনি কি করে বাবার থেকে ছোট হয়ে গেলো তা মিনির মাথায় ধরছে না। মিনির পাশ দিয়েই বাবা ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। মিনি আবদারের সুরে বাবাকে বললো, “বাবা, আমার আর একটা স্টিকার বুক চাই।”
“ঠিক আছে, মাম্মা… বিকেলে কিনতে যাবো।” ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই আদুরে কন্ঠে উত্তর দিলো রিয়াজ।
ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে গ্লাসে পানি ঢালছিলো রাইসা। বাপ মেয়ের আহ্লাদ দেখে বললো, “আবার স্টিকার বুক দিয়ে কি হবে? আগেরটা কোথায় হারিয়েছিস?”
“আহা… থাক না… স্টিকার বুকই তো।” ভ্রু জোড়া হালকা কুঁচকে মিনির পক্ষ নেয় বাবা। মিনিও নিজের মত সাদা প্লেনটা হাওয়ায় ঢেউ করে উড়াতে থাকে।
….……
বিকেলে বাবার কাঁধে করে ফিরে মিনি। রিয়াজের দু’হাত ভরা। রাইসা দ্রুত কিছু ব্যাগ হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি ফ্যাক্টরির সব স্টিকার বুক তুলে এনেছো নাকি?”
“তোমার মেয়েকে চিনো না এখনও? তোমার মতই হয়েছে। শপিং করতে গেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। যা পছন্দ হয়েছে সবই কিনেছে।” বলে শব্দ করে হেসে উঠলো রিয়াজ।
রাইসা আর মিনিও সাথে যোগ হলো। মিনি বসার ঘরে বসেই কি কি খেলনা কিনেছে সব দেখাতে লাগলো মাকে।
বসার ঘরে এতো অনন্দের কলরবে দাদুমনিও রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। মিনি দাদুমনিকেও মায়ের পাশে বসিয়ে সব দেখাতে লাগলো।
সব দেখে দাদুমনি কিছুটা শুকনো মুখে বাবাকে বললো, “অযথা এতো খরচের কি দরকার ছিলো, বাবা। মিনির তো এমনিতেই অনেক খেলনা। আর খেলনা দিয়ে তো মেয়েটা খেলেও না তেমন।”
কথাটা রাইসার পছন্দ হলো না। নিজের মেয়েকে ইচ্ছে মত একটু খেলনা কিনে দিয়েছে। তাতে এতো কথার, হিসেবের কি আছে। তবে রাইসা কথা না বাড়িয়ে উঠে চলে গেলো।
দাদুমনির কথায় মিনি খেলনাগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হলো ঠিকই তো কোনো দরকার ছিলো না খেলনাগুলোর। পরক্ষনেই মনে হলো নাহ্ সবগুলো খেলনাই মিনির চাই। খুব সুন্দর এগুলো।
রিয়াজ কোনো উত্তর দিলো না। রেহানা বেগম কিছুক্ষণ উত্তরের আশায় থেকে উঠে যেতে নিবেন এমন সময় হঠাৎ হাটুর ব্যাথায় আবার বসে পরলেন। কেউ খেয়াল না করলেও মিনি ঠিকই দাদুমনির পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো, “দাদু, তুমি হাটুতে ওষুধ লাগাও নি? আবার যে ব্যাথা করছে?”
“নারে”
“কেন?”
“এমনি…”
বলে রেহানা বেগম ধীরে ধীরে উঠে নিজের রুমের দিকে এগুলেন। পিছন পিছন ছুট দিলো মিনিও। ব্যাথার মলমটা শেষ হয়ে গিয়েছে প্রায় তিন চার দিন হবে হয়তো। ইতস্ততায় ছেলেকে এখনও মলমটা আনতে বলা হয়নি। আগের বার যখন ব্যাথা খুব বেশি ছিলো তখন মলমটা দ্রুত শেষ হয়েছিলো। তখন আনতে বলাতে রিয়াজ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলো, “সেদিনই না আনলাম, আম্মা! এত্তো তাড়াতাড়ি শেষ হলো কি করে।”
কথাটা খুব নির্দোষ। জানে রেহানা বেগম। কিন্তু এই নির্দোষ কথাটাই একেবার বুকের গভীরে লেগেছিলো কেন যেন। তাই তারপর আর মলমটা আনতে বলা হয়নি।
…….…..
“বাবা, আজ ছুটি প্লিজ আমরা বেড়াতে যাবো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ…” মেয়ের প্লিজের তোপে রিয়াজ রাজি হয়। রাইসাও বুকের কাছে হাত বেঁধে বলে, “ঠিক আছে তাহলে আমারও ছুটি। রান্না বাদ। বাইরে খাওয়া হবে।”
তাতেও রিয়াজ হাসি মুখেই রাজি হয়। নিজেও বুকের কাছে হাত বেঁধে উপর নীচে মাথা নাড়ে।
“ইয়ে…” বলে মিনি ইয়া বড় এক লাফ দেয়।
এক দৌড়ে দাদুমনিকে গিয়ে জানায় খুশির খবরটা। তড়িঘড়ি করে দাদুমনিকে রেডি হতে বলে। আর নিজেও পছন্দের ড্রেসটা পরে দাদুমনির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে চুল বেঁধে দেয়ার জন্য।
মিনির চুল বেঁধে দিয়ে রেহানা বেগম ছেলের কাছে এসে আমতা আমতা করে বলে, “আমি না গেলে হয় না? বাইরের এসব হাবিজাবি আমার ভালো লাগেনা।”
এমন আনন্দের মধ্যে মাকে রেখে যাওয়া কথা ভাবা যায়। রিয়াজ নিজেই মায়ের বোরখা এনে হাতে তুলে দিলো।
রাইসাও শাশুড়ি মাকে রেডি হতে সাহায্য করলো। জুতো জোড়া এগিয়ে দিলো।
….….
সবাই মিলে এসেছে রেস্টুরেন্টে। অর্ডার করা হয়েছে মিনি আর রাইসার পছন্দের সব খাবার।
সবাই ভর পেট খেয়ে নিলো। কিন্তু রেহানা বেগম দু’য়েকটা ফ্রেংস ফ্রাই মুখে তুলে বললো, “ধ্যাত! এতো টাকা খরচ না করে আমাকে একটু ডাবের পানি খাওয়াতি।তাতেই হতো”
কথাটা শুনে রিয়াজ শব্দ করে হেসে উঠলো।
ফিরে এসে যে যার মত ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু রেহানা বেগমের যে ক্ষুধায় অবস্থা খারাপ সেই কথাটা আর কেউ জানলো না।
……..
“আম্মা…”
“কিরে এখনও ঘুমালিনা?”
“তুমিও তো ঘুমাওনি… লাইট অন করবো? আসবো?”
“আয়…”
রিয়াজ রুমে এসে লাইটটা অন করলো। হাতে একটা প্লেট।
“কি নিয়ে এসেছিস?”
“তুমিই দেখে নাও…” বলে প্লেটের ঢাকনাটা খুললো রিয়াজ।
“খিচুড়ি?” অবাক দৃষ্টি রেহানা বেগমের, “কখন রাঁধলি? নাকও তো বন্ধ আমার। কোনো ঘ্রাণও পেলাম না।”
“আমি রাঁধিনি আম্মা, রাইসা বাইরে থেকে এসেই রেঁধেছে।”
“কেন?”
“তোমার পছন্দ, তাই। আর রেস্টুরেন্টেও তো তুমি তেমন কিছুই খেতে পারোনি, তাই। শুধু খিচুড়ি না গো আম্মা, ডাবের পানিও আছে”
রেহানা বেগমের মুখটা অনন্দে ঝলমল করে উঠলো। যদিও মুখে বললেন, “এখন এতো কষ্ট করার কি ছিলো। মেয়েটা পাগল নাকি!!”
মাকে খায়িয়ে রিয়াজ প্লেট রেখে আবার ফিরে এলো। এসেই যত্ন করে মায়ের পায়ে হাত দিলো।
রেহানা বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে, কি করছিস এসব?”
“তোমার ব্যাথার মলম শেষ এটা আমাকে আগে বলনি কেন?”
“ইয়ে মানে… তুই জানলি কি করে?” ইতস্তত প্রশ্ন রেহানা বেগমের।
“বিকালে যে বসা থেকে উঠতে সমস্যা হচ্ছিলো, দাও তো পায়ে মলম ডলে দেই।”
রেহানা বেগম আর আপত্তি করলেন না। ছেলেটা ভালো করেই মলম ডলে দিতে পারে। একবার ডলে দিলে কিছুদিন ব্যাথাটা কমই থাকে।
……….……
“আম্মু, বাবা কি করছে?” মায়ের কোলে কিছুটা ফিসফিস করেই বললো মিনি। ফিসফিস করে বলার কারণ খিচুড়ি রাঁধতে রাঁধতে মিনিকে রাইসা বুঝিয়ে দিয়েছে সে এখন সব আস্তে আস্তে করতে হবে। এটা দাদুমনির জন্য সারপ্রাইজ।
“দাদুমনির পা মাসাজ করে দিচ্ছে। দাদুমনির পায়ে ব্যথা যে তাই।”
“তাহলে আমরা দূরে কেন দাঁড়িয়ে আছি, আম্মু? কাছে গেলে কি হবে?”
“তোমার বাবা দাদুমনির বেবি না? তুমি যেমন আমার টুনটুন বেবি তেমন।”
“হ্যাঁ!”
“তো মাঝে মাঝে তোমার আমার সাথে অথবা আমার তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে ইচ্ছা হয় না?”
“হয় তো। পাশের বাসার সাবরিন আসলে বেশি ইচ্ছে হয়। ও যে শুধু তোমার সাথে খেলতে চায়। তাই…”
“হুম তেমন তোমার বাবারও ইচ্ছে হতে পারে। অথবা তোমার দাদুমনিরও। তাই আমরা কাছে যাচ্ছিনা।”
“আম্মু, দাদুমনি খুব সুন্দর তাই না?”
“হ্যাঁ! ঠিক আমার মিনি পরীটার মত।” বলে রাইসা আলতো করে একটু চুমু একে দেয় মিনির গালে।
….…..…..……
ছেলে লাইট অফ করে চলে যাবার পর রেহানা বেগমের মনে হলো আজ অনেকদিন পর আরামের ঘুম হবে। কিন্তু ঘুমনোর আগে একটা কাজ বাকি আছে।
রেহানা বেগম শোয়া থেকে উঠে অজু করে নিলেন।
অনেক দীর্ঘ দু’রাকাত সালাত পড়ে নিলেন। রিয়াজ, রাইসা, মিনি আর এই পরিবারে নতুন কেউ যদি আসে তাদের সবার জন্য হাত তুলে অনেক কিছু চেয়ে নিলেন তার রবের কাছ থেকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর থেকে ফিসফিস করে চাওয়া কিছু দু’আ সাথে সাথে কবুল হয়ে গেলো। লেখা হয়ে গেলো রিয়াজ, রাইসা, মিনি সহ তাদের অনাগত ভবিষ্যতের ললাটে।
অন্তরণ ও অনুরাগ
নুসরাত জাহান মুন
অগাস্ট ২৮, ২০১৯ইং